আশফাক সফল : বছর দুয়েক আগে হেমন্তের এক সকালে (১২ ডিসেম্বর ২০২২) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে “স্মার্ট বাংলাদেশ” কথাটি ব্যবহার করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে “রূপকল্প ২০৪১”-এর পরিকল্পনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ একইসঙ্গে উন্নত এবং স্মার্ট একটি দেশে পরিণত হবে। তাই তো ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ পেরিয়ে দেশ এখন ছুটে যাচ্ছে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে।
বাজেটের পরম্পরা
বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের ধারণা নিয়ে নতুন ধারার সূচনা করেন। ওনার পূর্বসূরিদের মধ্যে এম সাইফুর রহমান এবং শাহ এএমএস কিবরিয়া দীর্ঘ সময় কাজ করেছিলেন দারিদ্র্য বিমোচন, সাম্য এবং কর্মসংস্থান নিয়ে। পরবর্তীতে “রূপকল্প ২০২১”-কে ভিত্তি করে আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহত্তর বিনিয়োগ, উচ্চ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে “উন্নয়নের মহাসড়ক”-এর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিচয় করিয়ে দেন। উনার শেষ বাজেটের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ’। একই পরম্পরায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার প্রথম বাজেট করেছিলেন ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’। আর ২০২৩-২৪ সালের বাজেট ছিল ওনার সর্বশেষ বাজেট, তার শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’।
বাজেটের প্রকৃতি ও ধরনের দিক থেকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী তার উত্তরসূরিদের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন বলা যায়। অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেটই আবুল হাসান মাহমুদ আলী “স্মার্ট বাংলাদেশ”-কে লক্ষ্য হিসেবে ধরে রেখেছেন। ২০২৪-২৫ সালের প্রস্তাবিত বাজেটের শিরোনাম তিনি দিয়েছেন “টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা”।
বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ: মূল্যস্ফীতির চাপ সামলে পর্যাপ্ত খাদ্য, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি এবারের বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এর ধারণাকে। উন্নয়ন বাজেটের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের পরিকল্পনাকে। মূলত নির্বাচন পরবর্তী প্রথম বাজেটে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনি ইশতেহারের মূল থিম “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এর প্রতিফলন থাকবে সেটা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। ফলে বিস্তারিত নির্বাচনি ইশতেহারে “আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তারই দৃশ্যমান বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা, প্রযুক্তি-দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, সেবার ডিজিটালাইজেশন ইত্যাদিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে।
বাজেটে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য এবারও গুরুত্ব পেয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ধারণা শৈশবেই দেওয়ার উদ্দেশ্যে শিশুদের শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়েই বিভিন্ন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অব্যাহত থাকবে ডিজিটাল ক্লাসরুমসহ বিভিন্ন প্রকল্প। একইসঙ্গে সরকারি ও নির্বাচিত বেসরকারি বিদ্যালয়ে স্থাপিত হবে ১২ হাজারের বেশি কম্পিউটার ল্যাব এবং আর ৩৩ হাজার মাল্টিমিডিয়া ল্যাব। এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকের প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে কারিগরি শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত বরাদ্দের যে প্রয়োজনীয়তা ছিল, তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটেনি। এ কথা বিবেচনায় রাখতেই হবে স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম মূল ভিত্তি স্মার্ট অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মানানসই মানবসম্পদ আবশ্যক। আইওটি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার যথাযথ ব্যবহারের নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। তবে শিল্প খাতে ব্যবস্থাপনা দক্ষতার উন্নয়নের জন্য ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া বিষয়ক গৃহীত উদ্যোগগুলো প্রশংসার দাবিদার।
বাজেটের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্মার্ট বাংলাদেশকে যেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও স্মার্ট বাংলাদেশকে একই রকম প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে “স্মার্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড” হিসাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় আবার ব্যক্ত করা হয়। তবে শুল্ক আদায় ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিভিত্তিক কোনও নতুন উদ্যোগের কথা বাজেটে না আসায়, বিষয়টা দুঃখজনক।
ক্যাশলেস স্মার্টনেস: তথ্যপ্রযুক্তি ও স্মার্ট বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে সব থেকে বড় চমক ছিল কিছু শর্তসাপেক্ষে তিন বছরের জন্য করমুক্তি। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য তিন বছর কর অব্যাহতি পাবে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রায় ১৯টি সেবা, যার মধ্যে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, রোবটিক্স, সফটওয়্যার ক্লাউড সার্ভিস, ডাটা অ্যানালাইসিসের মতো উদীয়মান প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা। তবে শর্ত থাকে যে ডিজিটাল এই ব্যবসার লেনদেন হতে হবে ক্যাশলেস অর্থাৎ ডিজিটালি। এই তালিকায় উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোর পাশাপাশি স্থান পেয়েছে প্রথাগত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, কল সেন্টার, গ্রাফিক্স ডিজাইন, আইটি আউটসোর্স, সাইবার সিকিউরিটির মতো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাসমূহ।
কিছু বাধা: রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে মোবাইল সেবার বিপরীতে শুল্কের হার ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশে বৃদ্ধি হতাশাজনক। সমূহ সম্ভাবনা আছে সামগ্রিক প্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়ার। যেখানে ইন্টারনেটভিত্তিক ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, এবং দেশের বড় সংখ্যায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখন ক্যাবলভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার সঙ্গে যুক্ত নয়; সেখানে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত বেশ বড় আকারের প্রশ্নকে সামনে আনে। এছাড়া মোবাইল অপারেটরদের সিমকার্ড বিক্রির ওপর কর ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা হয়েছে।
শেষ কথা: স্মার্ট বাংলাদেশ এবং রূপকল্প ২০৪১ অর্জনের পথে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় বাজেট খরচের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ সালের বাজেটের আকার পূর্বতন বাজেটের থেকে বেড়েছিল ১৫ শতাংশেরও বেশি। নতুন অর্থমন্ত্রী অস্থিতিশীল আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মাঝেও ২০২৪-২৫ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে খরচের আকার কমিয়ে ১২ শতাংশের ঘরে আনার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। এর প্রভাবে পড়েছে শিক্ষা খাতে; বরাদ্দ শতকরা হিসাবে আটকে আছে আগের জায়গায়। একইসঙ্গে যোগাযোগ খাতেও পাঁচ হাজার কোটি টাকার খরচ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এসবের মাঝে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ চার হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ফেলা দৃষ্টিকটু। বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, করোনা অতিমারি-উত্তর প্রভাব আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে মূল্যস্ফীতি যখন ৯ শতাংশের বেশি দীর্ঘদিন ধরে। সেখানে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি ৬-এর ঘরে নিয়ে আসার বাজেটের জন্য শুভকামনা রাখতেই হয়।
লেখক: ব্লগার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ