বিশেষ সংবাদদাতা : এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ আবার উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে সরকার। রপ্তানি ঝুড়িতে এ চাল কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। এবার সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দিলেও পরিমাণ ও ন্যূনতম দাম বেঁধে দেবে সরকার। গত ২২ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ কমিটির সভায় সুগন্ধি চাল রপ্তানি উন্মুক্ত করার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এখন সুগন্ধি চালের রপ্তানিমূল্য ও রপ্তানির পরিমাণ নির্ধারণে ১১ সদস্যের একটি নতুন কমিটি করা হয়েছে। শিগগির মিটিং করে চাল রপ্তানির বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু সুগন্ধি চাল রপ্তানি করা হবে, তা ঠিক করা হবে এ কমিটিতে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সদস্য এ কমিটিতে আছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ।
কমিটিতে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের প্রতিনিধিরা আছেন। জানা যায়, এ কমিটি দেশে কী পরিমাণে সুগন্ধি চাল উৎপাদন হচ্ছে, এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কত সেটি নির্ধারণ করবে। এরপর কী পরিমাণে চাল কত দামে বিদেশে রপ্তানি করা যায় তা উল্লেখ করে জমা দেবে প্রতিবেদন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চাল রপ্তানির পরিমাণ ও ন্যূনতম দাম বেঁধে অনুমতি দেবে।
প্রতি কেজি চাল সরকার যদি এক ডলার ৩০ থেকে ৪০ সেন্ট বেঁধে দেয়, তবে এক কেজি সুগন্ধি চাল রপ্তানি করে তিন কেজি সাধারণ চাল আমদানি করা যাবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটবে, পাশাপাশি অন্য কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়বে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘শিগগির মিটিং করে চাল রপ্তানির বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু সুগন্ধি চাল রপ্তানি করা হবে, তা ঠিক করা হবে। এ কমিটিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সদস্য আছেন।’ বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সুগন্ধি চাল রপ্তানি শুরু হয়। প্রথমবার চাল রপ্তানি বন্ধ করা হয় ২০২২ সালে। এরপর মাঝে কিছু অনুমতি দিলেও ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে রপ্তানি ফের বন্ধ করে দেয় সরকার। তবে রপ্তানি শুরুর পর থেকে সুগন্ধি চাল বাংলাদেশি রপ্তানি ঝুড়িতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য হয়ে উঠেছিল। আমাদের রপ্তানির ঝুড়িতে সুগন্ধি চাল একটি জনপ্রিয় আইটেম।
চাল না দিতে পারলে অনেক সময় অন্য পণ্যের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যায়। সুগন্ধি চালের কারণে অন্য নানান ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়াতে দেশের ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক বলেন, ‘সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ থাকার সময় আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে বলেছিলাম প্রয়োজনে ন্যূনতম দাম ও পরিমাণ বেঁধে দিন, তারপরেও রপ্তানির সুযোগ থাক। কারণ এ দেশের একটি বড় পণ্য এ চাল। বাংলাদেশি চালের প্রচুর চাহিদা বিদেশে রয়েছে, সুনাম রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতি কেজি চাল সরকার যদি এক ডলার ৩০ থেকে ৪০ সেন্ট বেঁধে দেয়, তবে এক কেজি সুগন্ধি চাল রপ্তানি করে তিন কেজি সাধারণ চাল আমদানি করা যাবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটবে, পাশাপাশি অন্য কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়বে।
’ বাংলাদেশ থেকে চাল রপ্তানি বন্ধ থাকার সময় অসাধু উপায়ে এ বাজার ভারত দখল করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ কমিটির সভায় জানান, দেশের রপ্তানি বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সুগন্ধি চাল ভারতে পাচার হচ্ছে। কারণ উৎপাদন এলাকায় চালের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। সেসব চাল ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির নকল প্যাকেটে এতদিন রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় কিছু অসাধু রপ্তানিকারক এদেশ থেকে চাল নিয়ে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডিং ব্যবহার করে বিদেশে রপ্তানি করছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে সুগন্ধি চালের উল্লেখযোগ্য চাহিদা রয়েছে। ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ বলেন, ‘বাংলাদেশের সুগন্ধি চাল এখন বিদেশের অনেক দেশে ব্র্যান্ড প্রোডাক্ট।
এটি কখনো চালু, কখনো বন্ধ করে সরকার বাংলাদেশের বাজার নষ্ট করেছে। রপ্তানি বন্ধ থাকলে সব সময় দেশে উদ্বৃত্ত সুগন্ধি চাল থেকে যায়, চাষিরা দাম পায় না। গত কয়েক বছর সেটা হয়েছে। এদেশে উপলক্ষ-অনুষ্ঠান ছাড়া এ চালের চাহিদা নেই।’ জানা গেছে, দেশ থেকে প্রথম বছর ৬৬৩ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়। পরের বছরগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ হাজার ৮৭৯ টনে উন্নীত হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৬ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৫ লাখ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ লাখ মার্কিন ডলারের সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে গড়ে সুগন্ধি চাল উৎপাদন হয় ১৮-২০ লাখ টন। প্রতি বছর গড়ে রপ্তানি হয় ১০ হাজার টন। অর্থাৎ উৎপাদনের তুলনায় চালের রপ্তানির হিস্যা অনেক কম। যে কারণে চাল রপ্তানিতে খাদ্যনিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি নেই বলে দাবি করছেন রপ্তানিকারকরা। এ পর্যন্ত বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছে। দেশে রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি চালের একটি তালিকা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।
চালগুলো হচ্ছে কালিজিরা, কালিজিরা টিপিএল-৬২, চিনিগুঁড়া, চিনি আতপ, চিনি কানাই, বাদশাভোগ, কাটারিভোগ, মদনভোগ, রাঁধুনিপাগল, বাঁশফুল, জটাবাঁশফুল, বিন্নাফুল, তুলসীমালা, তুলসী আতপ, তুলসী মণি, মধুমালা, খোরমা, সাককুর খোরমা, নুনিয়া, পশুশাইল, দুলাভোগ ইত্যাদি।