প্রত্যাশা ডেস্ক: সিন্ধু নদ থেকে সামান্য দূরের একটি সবজিখেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন পাকিস্তানের কৃষক হোমলা ঠাকুর। তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। একদিকে সূর্যের প্রখর তাপ, আরেক দিকে নদীর পানি কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার কাশ্মীরে ভয়াবহ হামলার পর ভারত উজানে সিন্ধুর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
৪০ বছর বয়সী হোমলা ঠাকুর বলেন, ‘যদি তারা পানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে এই পুরো এলাকা, পুরো দেশ থর মরুভূমিতে পরিণত হবে। আমরা না খেয়ে মরব।’ কথাগুলো বলে স্প্রেগানের ট্যাংক ভরাতে নদীর দিকে ফিরে যান হোমলা।
দক্ষিণ-পূর্ব সিন্ধু প্রদেশের লতিফাবাদ এলাকায় প্রায় ৫ একর (প্রায় ২ হেক্টর) জায়গাজুড়ে চাষাবাদ করছেন হোমলা। তিব্বত থেকে উৎপত্তি হওয়া সিন্ধু নদ ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ এলাকায় এসে আরব সাগরে পতিত হয়েছে।
১৫ জনেরও বেশি পাকিস্তানি কৃষক ও একাধিক বিশেষজ্ঞের বক্তব্যেও হোমলা ঠাকুরের উদ্বেগগুলো প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃষ্টি কম হওয়ায় এমন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি গত বুধবার একতরফা স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি। এ চুক্তির কারণে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষি খামারের জন্য পানি পাওয়ার পথ নিশ্চিত হয়েছিল।
চুক্তি স্থগিত করে ভারত বলেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাকিস্তান নির্ভারযোগ্যভাবে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে।
গত মঙ্গলবার বিকেলে কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় ২৬ জন নিহত হন। ভারতের দাবি, কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা চালানো তিনজনের দুজন পাকিস্তানের নাগরিক। তবে ইসলামাবাদ এ ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ‘পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ বন্ধ বা বাধাগ্রস্ত করার যেকোনো চেষ্টা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে।’
সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অভিন্ন সিন্ধু নদ এবং এর শাখা নদীগুলোর পানিবণ্টন হয়ে আসছে।
দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত তাৎক্ষণিকভাবে পানিপ্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী, অভিন্ন তিনটি নদীতে ভারত শুধু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে পারে, বড় কোনো জলাধার বা বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না। তবে কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল বলেন, ‘সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না পৌঁছাতে পারে, তা আমরা নিশ্চিত করব।’
এ নিয়ে পাকিস্তানিদের মধ্যে আতঙ্কের বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি জবাব দেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ভারত নিজেদের কৃষিকাজের জন্য খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নিতে পারে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেরও পরিকল্পনা করছে তারা। যেগুলো শেষ হতে চার থেকে সাত বছর সময় লাগতে পারে।
ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান কুশবিন্দর ভোহরা বলেন, ভারত তাৎক্ষণিক যা করতে পারে তা হলো, নদীগুলোর পানিপ্রবাহ-সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করা, বন্যা সতর্কতা দেওয়া বন্ধ রাখা ও পার্মানেন্ট সিন্ধু কমিশনের আওতায় হওয়া বার্ষিক বৈঠকগুলো এড়িয়ে যাওয়া।
পার্মানেন্ট সিন্ধু কমিশন দুই দেশের একজন করে কর্মকর্তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
কুশবিন্দর একসময় ভারতের সিন্ধুবিষয়ক কমিশনারও ছিলেন এবং বর্তমানে মাঝেমধ্যে সরকারকে পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, ‘কখন পানি আসছে, কতটা আসছে, সেসব তথ্য তারা (পাকিস্তান) বেশি পাবে না। তথ্য ছাড়া তারা পরিকল্পনা করতে পারবে না।’
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিষয়টি শুধু (পাকিস্তানের) কৃষিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পানির ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপরও প্রভাব পড়বে। এতে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ ভাকার আহমেদ মনে করেন, ভারতের সিন্ধু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকিকে পাকিস্তান যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেনি। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে বন্যার সময় (সিন্ধু দিয়ে) দ্রুত পানিপ্রবাহ থামানো যাবে, এমন কোনো অবকাঠামো এখনো ভারতের নেই। তাই এ সময়টা পাকিস্তানের জন্য তাদের পানি খাতে বিদ্যমান অদক্ষতাগুলো দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে।’
এই অর্থনীতিবিদের মতে, ‘পানি খাতে ব্যবস্থাপনাগত অনেক অদক্ষতা রয়েছে ও অপচয় হচ্ছে।’
বিদ্যমান মতপার্থক্য: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনার চেষ্টা করে আসছে। কিষানগঙ্গা ও রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জলাধারের আয়তন নিয়ে দুই দেশ হেগের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে তাদের মতপার্থক্য মেটানোর চেষ্টা করছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান কুশবিন্দর ভোহরা বলেন, ‘এখন আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো আমাদের প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে পারব।’
গত বৃহস্পতিবার এক চিঠিতে ভারত পাকিস্তানকে বলেছে, চুক্তি স্বাক্ষরের সময় থেকে এখন জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে এবং অধিক পরিমাণে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছে তারা।
সিন্ধু প্রদেশের ১৫০ একরের কৃষি খামারের মালিক নাদিম শাহ তুলা, আখ, গম ও সবজি চাষ করেন। তিনিও পানির সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
নাদিম বলেন, ‘আমরা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখি, তবে ভারতের কার্যক্রম নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে।’
প্রায় ২৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত তিনটি অভিন্ন নদীর পানি ১ কোটি ৬০ লাখ হেক্টর পরিমাণ জমির সেচকাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা দেশের মোট কৃষিজমির প্রায় ৮০ শতাংশ।
করাচিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাকিস্তান অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চের গবেষক ঘাশারিব শওকত বলেন, ভারতের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে এমন একটি ব্যবস্থার মধ্যে অনিশ্চয়তা ঢুকে গেছে, যা নিয়ে কখনো অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার কথা ছিল না।
এই গবেষক আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই। এ চুক্তির আওতায় থাকা নদীগুলোর ওপর শুধু কৃষি খাতই নয়, বরং নগরব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা নির্ভর করে।’
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা সংঘাতে আটকে আছি। আর আমি মনে করি, সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে সরে গিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও নতুন এক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এটা কোনোভাবেই ঘটতে দেওয়া যাবে না।’
পাকিস্তানি রাজনীতিকেরা বলছেন, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান চারবার যুদ্ধে জড়ালেও এ চুক্তির ওপর প্রভাব পড়েনি। কিন্তু এবার চুক্তি স্থগিত হওয়ার বিষয়টি একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করল।
 
																			 
										






















