ঢাকা ১১:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংবিধানের বিতর্কিত ও বৈষম্যপূর্ণ ধারাগুলো

  • আপডেট সময় : ০৫:৩৫:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪
  • ২৭ বার পড়া হয়েছে

মো. জাকারিয়া হোসেন : নতুন সংবিধান পুনর্লিখন বা সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলমান। মূলত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সংবিধান নিয়ে আলোচনা চলছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞদের থেকে শুরু করে দেশের সচেতন নাগরিকদের অনেকে সংবিধান পরিবর্তন করে নতুন করে লেখার পক্ষে মত ব্যক্ত করছেন। অন্যদিকে কতিপয় আইন বিশারদ তা সংশোধন করে জনগণের ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর আগে যতবার সংশোধন করা হয়েছে, কোনওবারই সংবিধানের মালিক জনগণের মতামত চাওয়া হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রথমবারের মতো একটি ওয়েব সাইট লঞ্চ করেছে, যেখানে প্রত্যেক সচেতন নাগরিক সংবিধান বিষয়ে মতামত দিতে পারবেন। এটিই মূলত গণতন্ত্র। সেখানে জনগণ, তাদের উপলব্ধি অনুযায়ী মত ব্যক্ত করবে।
এদিকে আরেক বাস্তবতায় চব্বিশের বিপ্লবীরা সংবিধান নতুন করে লিখতে চাইছে। বাস্তবতাটি হচ্ছে বিপ্লবের পরে টিকে থাকা সহজ নয়। রাজনৈতিক দলগুলো বিপ্লবীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে কিন্তু তাদের প্রয়োজন শেষ হলে কঠোরভাবে দমন করবে। এর বহু নজির সারাবিশ্বে আছে।
বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল একটু বেশিই সুবিধা ভোগ করেছে। কাজেই নতুন করে আর কোনও সুবিধাভোগীর উত্থান হোক, এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ১৯৭১ সালের গণ-আকাঙ্ক্ষার আশানুরূপ বাস্তবায়ন বায়াত্তরের সংবিধানে হয়নি বলেই স্বাধীনতার মাত্র ৫৩ বছরে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান এদেশে সংঘটিত হয়েছে।
সুনাগরিকের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সংবিধান পড়ার বিকল্প নেই। সংবিধান পড়ার সুবাদে অনেক অসংগতি আমার দৃষ্টিগোচর হয়। কিছু ক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হলো যে, বর্তমান সংবিধানের বেশকিছু জায়গায় সংস্কার করা বাধ্যতামূলক। যেগুলোর সংস্কার না হলে দেশের মানুষের কাক্সিক্ষত মুক্তি আসবে না। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ
১. সংবিধানের সংস্কার করার জন্য প্রথমেই যে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে তা হলো, ২০১১ সালের অবৈধ পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতে হবে। বর্তমানে যেহেতু সংসদ নেই, তাই দৃশ্যত সংশোধন করার এখতিয়ার এই সরকারের নেই। কিন্তু ডকট্রিন অব নেসেসিটির আলোকে কাজটি করা যাবে। আবারও নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনও নির্বাচন করতে দেওয়া যাবে না।
২. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিটির সদস্যরা সংস্কার কিংবা সংশোধন করতে গেলে প্রথমেই যে বাধার সম্মুখীন হবেন সেটি হলো ১৪২ নং অনুচ্ছেদের (ক)-এর (আ)। এতে বলা আছে, কেবল দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদদের ভোট গৃহীত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির কাছে সংশোধনের জন্য বিল উপস্থাপন করা যাবে। বর্তমানে যেহেতু সংসদ অবশিষ্ট নেই, তাই এই অনুচ্ছেদের নিয়মকে সামনে রেখেই বিএনপি সংবিধানের সংস্কারে এই সরকারের পরোক্ষ বিরোধিতা করছে।
৩. দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন করতে হবে। ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ কিংবা ‘গণশাসনতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ নাম রাখা যেতে পারে। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’একটি স্ববিরোধী কথা। যেখানে সংবিধানে আছে দেশের মালিক জনগণ, কিন্তু পরিভাষায় বলা হচ্ছে প্রজাতন্ত্র। এখানে তো রাজা-প্রজা সম্পর্ক না।
৪. বর্তমান সংবিধানের ৪-এর(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাই বলে তার প্রতিকৃতি পূজার মতো অফিসে অফিসে টাঙানো একেবারেই অনর্থক। এই অনুচ্ছেদ যে কোনো সময় বাতিলযোগ্য।
৫. সংবিধানের ৭-এর (ক) এবং (খ) অনুচ্ছেদের সংশোধন ছাড়া সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখন অসম্ভব। কারণ, এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের সব উপদেষ্টা, বিপ্লবের সকল স্টেক হোল্ডারদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা যাবে।
৬. অনুচ্ছেদ ২৮ এর(৪) অনুযায়ী বিধানগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হোক। কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। এতে করে সমাজের অনগ্রসরতা কিছুটা লাঘব হবে।
৭. ৩৯ নং অনুচ্ছেদের প্রকৃত বাস্তবায়ন হোক। চিন্তা, মতামতের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে, মানুষ মন খুলে কথা বলার পরিবেশ না পেলে আবারও বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সেন্সরশিপ আরোপ করা যাবে না।
৮. ৪৫ ও ৪৬ নং অনুচ্ছেদের অপব্যবহার রোধ করা হোক, শৃঙ্খলা রক্ষার নামে অনেকের বিরুদ্ধে অবিচার করার সংস্কৃতি বন্ধ হোক। কেউ যদি উক্ত বিধান লঙ্ঘন করেন, তবে তাকে দায়মুক্তি না দিয়ে উপযুক্ত শাস্তির বিধান আরোপ করতে হবে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে কঠোরতার প্রয়োজন হলে বিশেষ নীতিমালা আরোপ করা যেতে পারে।
৯. ৪৭ নং (৩) এবং ৪৭-এর(ক) এর উপ-দফা (১) ও (২) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে কত মানুষের প্রতি অবিচার করা হয়েছে তার সংখ্যা অনির্ণেয়। বিরোধীদলকে দমন করতে এই জঘন্যতম অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়েছিল পঞ্চদশ সংশোধনীতে। যার মাধ্যমে অনেক মানুষকে মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল। এমনকি কেউ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারও হারিয়েছিল। বিএনপি- জামায়াতের কত নিরীহ ব্যক্তিকে শাস্তি পেতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
১০. ৫১ ও ৫২ নং অনুচ্ছেদেও চাহিদ অনুসারে সংশোধন বা সংস্কার করতে হবে। কেবল সংসদ কেন রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারবে? সুশীল সমাজ কিংবা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কেন রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলতে পারবে না কেন? দেশবিরোধী কিংবা অন্যান্য উপযুক্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা যাবে না কেন?
১১. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি হাতের পুতুলমাত্র। তাকে যেমন খুশি ব্যবহার করা যায়। তাই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে হলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
১২. একজন ব্যক্তি একই সাথে রাষ্ট্রপ্রধান এবং দলীয় প্রধান হতে পারবেন না। আর একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৪ বছর করা সময়ের দাবি।
১৩. ৬৬ নং অনুচ্ছেদের আইন প্রয়োগ আরো কঠোর করা দরকার। নির্বাচন কমিশনকে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য চাপ দিতে হবে। কেউ মিথ্যা বা অসত্য তথ্য দিলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত করার বিধান চালু করতে হবে। বিগত সরকারের কমপক্ষে ২৪ জন সাংসদ দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। যেটা স্পষ্টত সংবিধানের বিরোধী এবং গুরুতর অপরাধ। প্রতারণার মাধ্যমে জনসেবার মিথ্যে আশ্বাসের জন্য তারা অপরাধী।
১৪. সংবিধানের অন্যতম আলোচিত এবং বিতর্কিত অনুচ্ছেদ হলো ৭০ নং অনুচ্ছেদ, যেটি বাতিল করতেই হবে। এতে নৈতিকতা প্রাধান্য পাক দল-মতের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা কিংবা দলের বিরুদ্ধে বললে সংসদে তার আসন শূন্য হবে কেন? এর মাধ্যমে দেশ বিরোধী কাজ করলেও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন না। সংবিধানে যতগুলো অসঙ্গতি আর ক্রটিপূর্ণ অনুচ্ছেদ আছে তন্মধ্যে ৭০ নং অনুচ্ছেদ অন্যতম।
১৫. এর থেকে আর মোক্ষম সময় আর হতে পারে না ৭৭ নং অনুচ্ছেদকে বাস্তবায়ন করার। সর্বজন স্বীকৃত ব্যক্তিকে ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক। আমলা ও সাংসদসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরার জন্য ন্যায়পালে নিয়োগ দেওয়া উচিত। স্বাধীনতার পর থেকেই ন্যায়পাল নিয়োগের কথা চলমান ছিলো। স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও মহাগুরুত্বপূর্ণ এই সাংবিধানিক পদে আজ পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কোনও রাজনৈতিক সরকার এর উদাহরণ বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। উদ্যোগ গ্রহণ করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো। তাই অন্যান্য আলোচনার পাশাপাশি ন্যায়পালের কথাও বিশেষভাবে প্রাধান্য পাক।
১৬. ৭৮ নং অনুচ্ছেদে দফাগুলোতে সাংসদদের দায়মুক্তি ও বিশেষ অধিকারের বিধানের কথা আছে। সংসদের কার্যক্রম সম্পর্কে আদালতে কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। এর মাধ্যমেই সাংসদরা কেউ কেউ একজন মূর্তিমান গডফাদার হিসেবে আবির্ভূত হন।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

গুমে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা পেয়েছে কমিশন

সংবিধানের বিতর্কিত ও বৈষম্যপূর্ণ ধারাগুলো

আপডেট সময় : ০৫:৩৫:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

মো. জাকারিয়া হোসেন : নতুন সংবিধান পুনর্লিখন বা সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলমান। মূলত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সংবিধান নিয়ে আলোচনা চলছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞদের থেকে শুরু করে দেশের সচেতন নাগরিকদের অনেকে সংবিধান পরিবর্তন করে নতুন করে লেখার পক্ষে মত ব্যক্ত করছেন। অন্যদিকে কতিপয় আইন বিশারদ তা সংশোধন করে জনগণের ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর আগে যতবার সংশোধন করা হয়েছে, কোনওবারই সংবিধানের মালিক জনগণের মতামত চাওয়া হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রথমবারের মতো একটি ওয়েব সাইট লঞ্চ করেছে, যেখানে প্রত্যেক সচেতন নাগরিক সংবিধান বিষয়ে মতামত দিতে পারবেন। এটিই মূলত গণতন্ত্র। সেখানে জনগণ, তাদের উপলব্ধি অনুযায়ী মত ব্যক্ত করবে।
এদিকে আরেক বাস্তবতায় চব্বিশের বিপ্লবীরা সংবিধান নতুন করে লিখতে চাইছে। বাস্তবতাটি হচ্ছে বিপ্লবের পরে টিকে থাকা সহজ নয়। রাজনৈতিক দলগুলো বিপ্লবীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে কিন্তু তাদের প্রয়োজন শেষ হলে কঠোরভাবে দমন করবে। এর বহু নজির সারাবিশ্বে আছে।
বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল একটু বেশিই সুবিধা ভোগ করেছে। কাজেই নতুন করে আর কোনও সুবিধাভোগীর উত্থান হোক, এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ১৯৭১ সালের গণ-আকাঙ্ক্ষার আশানুরূপ বাস্তবায়ন বায়াত্তরের সংবিধানে হয়নি বলেই স্বাধীনতার মাত্র ৫৩ বছরে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান এদেশে সংঘটিত হয়েছে।
সুনাগরিকের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সংবিধান পড়ার বিকল্প নেই। সংবিধান পড়ার সুবাদে অনেক অসংগতি আমার দৃষ্টিগোচর হয়। কিছু ক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হলো যে, বর্তমান সংবিধানের বেশকিছু জায়গায় সংস্কার করা বাধ্যতামূলক। যেগুলোর সংস্কার না হলে দেশের মানুষের কাক্সিক্ষত মুক্তি আসবে না। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ
১. সংবিধানের সংস্কার করার জন্য প্রথমেই যে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে তা হলো, ২০১১ সালের অবৈধ পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতে হবে। বর্তমানে যেহেতু সংসদ নেই, তাই দৃশ্যত সংশোধন করার এখতিয়ার এই সরকারের নেই। কিন্তু ডকট্রিন অব নেসেসিটির আলোকে কাজটি করা যাবে। আবারও নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনও নির্বাচন করতে দেওয়া যাবে না।
২. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিটির সদস্যরা সংস্কার কিংবা সংশোধন করতে গেলে প্রথমেই যে বাধার সম্মুখীন হবেন সেটি হলো ১৪২ নং অনুচ্ছেদের (ক)-এর (আ)। এতে বলা আছে, কেবল দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদদের ভোট গৃহীত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির কাছে সংশোধনের জন্য বিল উপস্থাপন করা যাবে। বর্তমানে যেহেতু সংসদ অবশিষ্ট নেই, তাই এই অনুচ্ছেদের নিয়মকে সামনে রেখেই বিএনপি সংবিধানের সংস্কারে এই সরকারের পরোক্ষ বিরোধিতা করছে।
৩. দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন করতে হবে। ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ কিংবা ‘গণশাসনতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ নাম রাখা যেতে পারে। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’একটি স্ববিরোধী কথা। যেখানে সংবিধানে আছে দেশের মালিক জনগণ, কিন্তু পরিভাষায় বলা হচ্ছে প্রজাতন্ত্র। এখানে তো রাজা-প্রজা সম্পর্ক না।
৪. বর্তমান সংবিধানের ৪-এর(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাই বলে তার প্রতিকৃতি পূজার মতো অফিসে অফিসে টাঙানো একেবারেই অনর্থক। এই অনুচ্ছেদ যে কোনো সময় বাতিলযোগ্য।
৫. সংবিধানের ৭-এর (ক) এবং (খ) অনুচ্ছেদের সংশোধন ছাড়া সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখন অসম্ভব। কারণ, এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের সব উপদেষ্টা, বিপ্লবের সকল স্টেক হোল্ডারদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা যাবে।
৬. অনুচ্ছেদ ২৮ এর(৪) অনুযায়ী বিধানগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হোক। কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। এতে করে সমাজের অনগ্রসরতা কিছুটা লাঘব হবে।
৭. ৩৯ নং অনুচ্ছেদের প্রকৃত বাস্তবায়ন হোক। চিন্তা, মতামতের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে, মানুষ মন খুলে কথা বলার পরিবেশ না পেলে আবারও বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সেন্সরশিপ আরোপ করা যাবে না।
৮. ৪৫ ও ৪৬ নং অনুচ্ছেদের অপব্যবহার রোধ করা হোক, শৃঙ্খলা রক্ষার নামে অনেকের বিরুদ্ধে অবিচার করার সংস্কৃতি বন্ধ হোক। কেউ যদি উক্ত বিধান লঙ্ঘন করেন, তবে তাকে দায়মুক্তি না দিয়ে উপযুক্ত শাস্তির বিধান আরোপ করতে হবে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে কঠোরতার প্রয়োজন হলে বিশেষ নীতিমালা আরোপ করা যেতে পারে।
৯. ৪৭ নং (৩) এবং ৪৭-এর(ক) এর উপ-দফা (১) ও (২) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে কত মানুষের প্রতি অবিচার করা হয়েছে তার সংখ্যা অনির্ণেয়। বিরোধীদলকে দমন করতে এই জঘন্যতম অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়েছিল পঞ্চদশ সংশোধনীতে। যার মাধ্যমে অনেক মানুষকে মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল। এমনকি কেউ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারও হারিয়েছিল। বিএনপি- জামায়াতের কত নিরীহ ব্যক্তিকে শাস্তি পেতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
১০. ৫১ ও ৫২ নং অনুচ্ছেদেও চাহিদ অনুসারে সংশোধন বা সংস্কার করতে হবে। কেবল সংসদ কেন রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারবে? সুশীল সমাজ কিংবা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কেন রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলতে পারবে না কেন? দেশবিরোধী কিংবা অন্যান্য উপযুক্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা যাবে না কেন?
১১. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি হাতের পুতুলমাত্র। তাকে যেমন খুশি ব্যবহার করা যায়। তাই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে হলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
১২. একজন ব্যক্তি একই সাথে রাষ্ট্রপ্রধান এবং দলীয় প্রধান হতে পারবেন না। আর একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৪ বছর করা সময়ের দাবি।
১৩. ৬৬ নং অনুচ্ছেদের আইন প্রয়োগ আরো কঠোর করা দরকার। নির্বাচন কমিশনকে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য চাপ দিতে হবে। কেউ মিথ্যা বা অসত্য তথ্য দিলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত করার বিধান চালু করতে হবে। বিগত সরকারের কমপক্ষে ২৪ জন সাংসদ দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। যেটা স্পষ্টত সংবিধানের বিরোধী এবং গুরুতর অপরাধ। প্রতারণার মাধ্যমে জনসেবার মিথ্যে আশ্বাসের জন্য তারা অপরাধী।
১৪. সংবিধানের অন্যতম আলোচিত এবং বিতর্কিত অনুচ্ছেদ হলো ৭০ নং অনুচ্ছেদ, যেটি বাতিল করতেই হবে। এতে নৈতিকতা প্রাধান্য পাক দল-মতের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা কিংবা দলের বিরুদ্ধে বললে সংসদে তার আসন শূন্য হবে কেন? এর মাধ্যমে দেশ বিরোধী কাজ করলেও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন না। সংবিধানে যতগুলো অসঙ্গতি আর ক্রটিপূর্ণ অনুচ্ছেদ আছে তন্মধ্যে ৭০ নং অনুচ্ছেদ অন্যতম।
১৫. এর থেকে আর মোক্ষম সময় আর হতে পারে না ৭৭ নং অনুচ্ছেদকে বাস্তবায়ন করার। সর্বজন স্বীকৃত ব্যক্তিকে ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক। আমলা ও সাংসদসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরার জন্য ন্যায়পালে নিয়োগ দেওয়া উচিত। স্বাধীনতার পর থেকেই ন্যায়পাল নিয়োগের কথা চলমান ছিলো। স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও মহাগুরুত্বপূর্ণ এই সাংবিধানিক পদে আজ পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কোনও রাজনৈতিক সরকার এর উদাহরণ বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। উদ্যোগ গ্রহণ করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো। তাই অন্যান্য আলোচনার পাশাপাশি ন্যায়পালের কথাও বিশেষভাবে প্রাধান্য পাক।
১৬. ৭৮ নং অনুচ্ছেদে দফাগুলোতে সাংসদদের দায়মুক্তি ও বিশেষ অধিকারের বিধানের কথা আছে। সংসদের কার্যক্রম সম্পর্কে আদালতে কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। এর মাধ্যমেই সাংসদরা কেউ কেউ একজন মূর্তিমান গডফাদার হিসেবে আবির্ভূত হন।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়