ঢাকা ১০:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শোকাবহ আগস্ট সবার উপরে দেশ

  • আপডেট সময় : ১০:৩৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট ২০২৪
  • ৯৩ বার পড়া হয়েছে

ড. হারুন রশীদ : শুরু হলো বাঙালি জাতির জন্য নিষ্ঠুরতম মাস আগস্ট। আগস্ট কান্নার মাস। বেদনার মাস। শোকাবহ আগস্টে বাঙালি জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অঙুলির নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি একাত্তরে ‘যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। সেই তাঁকেই কি না জীবন দিতে হলো এ দেশেরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে, যা ছিল কল্পনারও অতীত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল ঘাতকচক্র। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে তারা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি ভাবধারায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যাতে হতে না পারে সেজন্য খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন খুনিদের রক্ষায়। জিয়া সেই অধ্যাদেশ আইনে পরিণত করেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে এ কালো আইনটি বাতিল করে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। যদিও দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন রয়ে গেছে দেশের বাইরে। সত্যি বলতে কী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাজনীতির বিপথগামিতার শুরু হয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টানতে না পেরে দলছুটদের নিয়ে দল গঠন করলেন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। হালুয়া-রুটির আশায় অনেকেই ভিড়লেন সে দলে। দলছুটদের পেয়ে তাঁর মনে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। জিয়া নিজেই ঘোষণা করলেন, রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করার কথা।
যে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন করলেন, ছয় দফাকে জনপ্রিয় করলেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করলেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করলেন—সেই ছাত্ররাজনীতির উর্বর ভূমিতে রোপণ করা হলো স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতালিপ্সার বিষবৃক্ষ। অস্ত্র, টাকা, আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ছাত্রদের একটি অংশকে দলে টানতে সক্ষম হলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। বিষবৃক্ষে জল ঢাললেন। অনেক ছাত্রনেতা ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা পেয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেন। এর মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে কলুষতার ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকলেন ছাত্রনেতারা। অনেকেই এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত হলেন। অস্ত্র, টাকা হাতে পেয়ে অরাজকতায় লিপ্ত হলো ওই সব ছাত্র। ছাত্ররাজনীতি থেকে আদর্শ নামক বস্তুটি হারিয়ে যেতে থাকল। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি থেকেও। কেননা সামরিক শাসন আমলে একটি নব্য ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হওয়ায় তারা ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইলেন।
সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠলো। এমনকি তারা ক্ষমতার অংশীদার পর্যন্ত হলো। শুধু রাজনীতি নয়, ধর্মকে পুঁজি করে তারা ব্যাংক-বিমাসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে ‘মৌলবাদের অর্থনীতি’ এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিল। রাজনীতিতে জায়গা করে নিল সাম্প্রদায়িকতা। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ায় একটি সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হলো। সামরিক শাসকদের সৃষ্টি করা দলগুলো এই বিভাজন আরও প্রকট করে তুলল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে এভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রাখা হলো। এভাবে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কার্যত সামরিক শাসকের উত্তরসূরিরাই ক্ষমতায় থেকে গেলো। ফলে গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারল না। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতুতে এখন যানবাহন চলছে। বঙ্গবন্ধূ স্যাটেলাইট আকাশে পৌঁছেছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হয়েছে বঙ্গবন্ধূ টানেল। রাজধানীর বুকে মেট্রোরেল চলছে দাপিয়ে। নানা সংকটের মধ্যেও এগিয়ে চলেছে উন্নয়শীল বাংলাদেশ। আর্থ-সামাজিক নানান দিক থেকেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, রাজনৈতিক নানান বিরোধ এখনো রয়েই গেছে। ক্ষমতায় থাকা না থাকার ইস্যুগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। সমঝোতার পরিবর্তে বৈরিতাই স্থান করে নিচ্ছে রাজনীতিতে। এ অবস্থা দেশকে এক সংকটজনক অবস্থায় নিপতিত করছে। কিন্তু এ অবস্থা তো কারও কাম্য হতে পারে না। তাই জনকল্যাণের রাজনীতিই সবার প্রত্যাশা। পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে এলেও এখনো অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা রয়ে গেছে। তাই জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সবার উপরে দেশ। আর কোনো রক্তপাত, সংঘাত, সহিংসতা নয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাক। জনজীবনে নেমে আসুক স্বস্তি। দেশের রাজনীতি হোক জনকল্যাণে। বঙ্গবন্ধু যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন দিয়ে গেছেন।
দুই.
এবার আগস্ট এসেছে এমন এক সময়ে যখন দেশে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসহ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল ছাত্ররা। সরকার আদালতের রায়ের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ করেই ঘোলাটে হয়। চলে ব্যাপক সহিংসতা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৫ জুলাই থেকে উত্তাল সারাদেশের শিক্ষাঙ্গন। ১৭ জুলাই থেকে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়, যা ২০ জুলাই পর্যন্ত থেমে থেমে চলে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শেষ দিকে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর চালায়। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জারি করা হয় কারফিউ। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত এ আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে সারাদেশে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে আদালতের রায় অনুযায়ী কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ (যেমন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সব গ্রেডে সরাসরি নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ। বাকি পদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা থাকবে। তবে নির্ধারিত এই কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে কোটার শূন্য পদও সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে গত ৩০ জুলাই মঙ্গলবার দেশব্যাপী শোক পালন করা হয়। প্রত্যাশিত সংস্কার হওয়ার পর এখন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। সহিংসতায় মৃত্যু ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে তারা এই কর্মসূচি দিয়েছে। পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে এলেও এখনো অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা রয়ে গেছে। তাই জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সবার উপরে দেশ। আর কোনো রক্তপাত, সংঘাত, সহিংসতা নয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাক। জনজীবনে নেমে আসুক স্বস্তি। দেশের রাজনীতি হোক জনকল্যাণে। বঙ্গবন্ধু যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জনকল্যাণই ছিল মুখ্য বিষয়। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় শোকের মাস আগস্টে নতুন করে শপথ নিতে হবে, যাতে জনকল্যাণই মুখ্য বিষয় হয় রাজনীতির। অনিশ্চিত অন্ধকারের পথে আর এক মুহূর্ত নয়। হীনস্বার্থ নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের একটি সুখী সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শুধু বঙ্গবন্ধুসহ সব শহীদের রক্তঋণ শোধ করা সম্ভব। সবাইকে এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে।

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

শোকাবহ আগস্ট সবার উপরে দেশ

আপডেট সময় : ১০:৩৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট ২০২৪

ড. হারুন রশীদ : শুরু হলো বাঙালি জাতির জন্য নিষ্ঠুরতম মাস আগস্ট। আগস্ট কান্নার মাস। বেদনার মাস। শোকাবহ আগস্টে বাঙালি জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অঙুলির নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি একাত্তরে ‘যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। সেই তাঁকেই কি না জীবন দিতে হলো এ দেশেরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে, যা ছিল কল্পনারও অতীত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল ঘাতকচক্র। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে তারা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি ভাবধারায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যাতে হতে না পারে সেজন্য খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন খুনিদের রক্ষায়। জিয়া সেই অধ্যাদেশ আইনে পরিণত করেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে এ কালো আইনটি বাতিল করে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। যদিও দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন রয়ে গেছে দেশের বাইরে। সত্যি বলতে কী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাজনীতির বিপথগামিতার শুরু হয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টানতে না পেরে দলছুটদের নিয়ে দল গঠন করলেন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। হালুয়া-রুটির আশায় অনেকেই ভিড়লেন সে দলে। দলছুটদের পেয়ে তাঁর মনে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। জিয়া নিজেই ঘোষণা করলেন, রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করার কথা।
যে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন করলেন, ছয় দফাকে জনপ্রিয় করলেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করলেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করলেন—সেই ছাত্ররাজনীতির উর্বর ভূমিতে রোপণ করা হলো স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতালিপ্সার বিষবৃক্ষ। অস্ত্র, টাকা, আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ছাত্রদের একটি অংশকে দলে টানতে সক্ষম হলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। বিষবৃক্ষে জল ঢাললেন। অনেক ছাত্রনেতা ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা পেয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেন। এর মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে কলুষতার ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকলেন ছাত্রনেতারা। অনেকেই এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত হলেন। অস্ত্র, টাকা হাতে পেয়ে অরাজকতায় লিপ্ত হলো ওই সব ছাত্র। ছাত্ররাজনীতি থেকে আদর্শ নামক বস্তুটি হারিয়ে যেতে থাকল। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি থেকেও। কেননা সামরিক শাসন আমলে একটি নব্য ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হওয়ায় তারা ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইলেন।
সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠলো। এমনকি তারা ক্ষমতার অংশীদার পর্যন্ত হলো। শুধু রাজনীতি নয়, ধর্মকে পুঁজি করে তারা ব্যাংক-বিমাসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে ‘মৌলবাদের অর্থনীতি’ এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিল। রাজনীতিতে জায়গা করে নিল সাম্প্রদায়িকতা। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ায় একটি সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হলো। সামরিক শাসকদের সৃষ্টি করা দলগুলো এই বিভাজন আরও প্রকট করে তুলল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে এভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রাখা হলো। এভাবে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কার্যত সামরিক শাসকের উত্তরসূরিরাই ক্ষমতায় থেকে গেলো। ফলে গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারল না। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতুতে এখন যানবাহন চলছে। বঙ্গবন্ধূ স্যাটেলাইট আকাশে পৌঁছেছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হয়েছে বঙ্গবন্ধূ টানেল। রাজধানীর বুকে মেট্রোরেল চলছে দাপিয়ে। নানা সংকটের মধ্যেও এগিয়ে চলেছে উন্নয়শীল বাংলাদেশ। আর্থ-সামাজিক নানান দিক থেকেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, রাজনৈতিক নানান বিরোধ এখনো রয়েই গেছে। ক্ষমতায় থাকা না থাকার ইস্যুগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। সমঝোতার পরিবর্তে বৈরিতাই স্থান করে নিচ্ছে রাজনীতিতে। এ অবস্থা দেশকে এক সংকটজনক অবস্থায় নিপতিত করছে। কিন্তু এ অবস্থা তো কারও কাম্য হতে পারে না। তাই জনকল্যাণের রাজনীতিই সবার প্রত্যাশা। পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে এলেও এখনো অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা রয়ে গেছে। তাই জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সবার উপরে দেশ। আর কোনো রক্তপাত, সংঘাত, সহিংসতা নয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাক। জনজীবনে নেমে আসুক স্বস্তি। দেশের রাজনীতি হোক জনকল্যাণে। বঙ্গবন্ধু যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন দিয়ে গেছেন।
দুই.
এবার আগস্ট এসেছে এমন এক সময়ে যখন দেশে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসহ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল ছাত্ররা। সরকার আদালতের রায়ের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ করেই ঘোলাটে হয়। চলে ব্যাপক সহিংসতা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৫ জুলাই থেকে উত্তাল সারাদেশের শিক্ষাঙ্গন। ১৭ জুলাই থেকে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়, যা ২০ জুলাই পর্যন্ত থেমে থেমে চলে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শেষ দিকে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর চালায়। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জারি করা হয় কারফিউ। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত এ আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে সারাদেশে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে আদালতের রায় অনুযায়ী কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ (যেমন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সব গ্রেডে সরাসরি নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ। বাকি পদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা থাকবে। তবে নির্ধারিত এই কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে কোটার শূন্য পদও সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে গত ৩০ জুলাই মঙ্গলবার দেশব্যাপী শোক পালন করা হয়। প্রত্যাশিত সংস্কার হওয়ার পর এখন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। সহিংসতায় মৃত্যু ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে তারা এই কর্মসূচি দিয়েছে। পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে এলেও এখনো অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা রয়ে গেছে। তাই জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সবার উপরে দেশ। আর কোনো রক্তপাত, সংঘাত, সহিংসতা নয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাক। জনজীবনে নেমে আসুক স্বস্তি। দেশের রাজনীতি হোক জনকল্যাণে। বঙ্গবন্ধু যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জনকল্যাণই ছিল মুখ্য বিষয়। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় শোকের মাস আগস্টে নতুন করে শপথ নিতে হবে, যাতে জনকল্যাণই মুখ্য বিষয় হয় রাজনীতির। অনিশ্চিত অন্ধকারের পথে আর এক মুহূর্ত নয়। হীনস্বার্থ নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের একটি সুখী সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শুধু বঙ্গবন্ধুসহ সব শহীদের রক্তঋণ শোধ করা সম্ভব। সবাইকে এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে।