নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘মুক্ত স্বাধীন নতুন বাংলাদেশকে’ মুছে দিতে ‘কল্পকাহিনি’ প্রচার করা হচ্ছে মন্তব্য করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তা ঠেকাতে এক জোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে এ আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না মন্তব্য করে প্রায় চার মাস ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নানাভাবে নানা গতিতে এটিকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা গত ৫ আগস্টের পর থেকে কত রকমভাবে যে এসেছে সেটা আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন।” ‘অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি তারা’ এটা ‘মুছে দিতে চায়’ মন্তব্য করে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, তারা নতুন নতুন বেশে নতুনভাবে চেষ্টা করেই যাচ্ছে। এখন যে চেষ্টা চলছে সেটার বিশেষ একটা রূপ আছে। সেজন্য বিশেষভাবে আপনাদের ডাকা।
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠায় এ সংলাপে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন। দলের আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি দলে ছিলেন নায়েবে আমির মজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি(এনপিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি) নেতারাও সংলাপে যোগ দিয়েছিলেন। সংলাপের সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা যে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে সেটি ধামাচাপা দিয়ে ‘আরেক বাংলাদেশের’ কাহিনী রচনার অপচেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে বলেন, এটা যে শুধু এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে তাও নয়। বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যে এটা ছড়িয়ে গেছে। আমাদের বিরাট অভ্যুত্থানটা তাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটা মুছে দিতে চায়, আড়াল করতে চায়। এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায় যেন-আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়ে গিয়েছে সেখান থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। সংলাপের শুরুতে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে ইউনূস বলেন, সেটা মিথ্যা প্রমাণ করা, বাস্তবকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবার এক জোট হতে হবে। এটা কোন বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের কিছু না, জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। নানা দিক থেকে তারা একটা কাল্পনিক বাংলাদেশ তৈরি করেছে দুনিয়ার সামনে, তাদের শক্তি এত বেশি। ক্রমে ক্রমে তারা মানুষকে এটাতে ভেড়াতে পারছে, এই যে নতুন কল্পকাহিনি তারা তৈরি করছে। তা নিয়ে অনেকে সন্দেহও প্রকাশ করেছে-এখানে কি ধরনের সরকার হয়েছে। তাদের কী আমরা বাধা দিয়েছি আসতে? আমরা তাদের বলেছি, আসেন দেখে যান। এখানে কোন বাধা নাই। কিন্তু তারা ওখান থেকে কল্পকাহিনী বানিয়ে যাচ্ছেন।
অপপ্রচার ঠেকাতে সবাইকে একজোট হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে আমরা এক। আমরা যা পেয়েছি তা এক যোগে পেয়েছি। কোনো মতভেদের মধ্যে পাইনি। কাউকে ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি। যারা আমাদের বুকের ওপর চেপেছিল তাদেরকে আমরা বের করে দিয়েছি। আমরা নিজেরাই উন্মুক্ত হয়েছি। সে জিনিসটা সবার সামনে তুলে ধরা। কীভাবে তুলবো এ ব্যাপারে পরামর্শ-সবাই মিলে যেন আমরা এটা করতে পারি। তিনি বলেন, কারণ নতুন বাংলাদেশের যাত্রা পথে এটা একটা মস্তবড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জিনিস আমাদের মনের ভেতর যেটা আছে সেটা সবার সামনে একত্রিত হয়ে বললে আমাদের শক্তি সমবেত শক্তি হিসাবে আসবে।
তিন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পরামর্শ চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা: দেশে উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিন বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমি থেকে বের হয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) যুগ্ম সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ সাংবাদিকদের এ কথা জানান। এ সময় বৈঠকের এজেন্ডা সরকারের পক্ষে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান তুলে ধরেন বলেও জানান তিনি। আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে-ভারতসহ সারা বিশ্বে যে প্রোপাগান্ডা চলছে সেগুলোর বিষয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয়, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন অফিস ভাঙচুর ও পতাকা অপমান করা নিয়ে করণীয় এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে গল্প ও উপন্যাস সারা দুনিয়ায় চলছে তা নিয়ে মতামত। এদিন বৈঠকে নির্বাচন বিষয়ে কোনো আলোচনা রাখা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, সব দল তাদের মতামত তুলে ধরছে, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয় কী। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যে আলোচনা হয়েছে তা হলো-বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আজকের আলোচ্যসূচিতে নির্বাচন না থাকলেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়ার জন্য তাগাদা দেয়। স্বরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কিছু মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে অনেকে সেবার একটা ঘাটতি বোধ করছেন, এক্ষেত্রে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে। সবাই রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করেছেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমরা আপনাদের পেছনে আছি। আপনাদের সিদ্ধান্ত ও লড়াইয়ের পেছনে আমরা অংশীদার। এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব বলেন, বৈঠকে একজন সাবেক মিলিটারি অফিসার, যিনি একটি দলেরও প্রধান, তিনি ভারতের সঙ্গে উসকানি ও উদ্বেগের জায়গা থেকে কীভাবে ভারসাম্যের জায়গায় নিয়ে আসা যায় তার জন্য কাজের পরামর্শ দেন। দুই-একজন পরামর্শ দিয়েছেন সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে একটি জাতীয় কমিশন করা যায় কিনা। জাতীয় কমিশন করলে ৫০ বছরের বঞ্চনা, বিশেষ করে গত ১৬ বছরে যে বঞ্চনা হয়েছে তার সত্যতা কতটুকু, তা বের হয়ে আসবে- এমন মতামতও কেউ কেউ দিয়েছেন বলে জানান ফুয়াদ। তিনি বলেন, কিছু মতামত এসেছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রে যেসব অ্যাম্বাসি আছে, সেখানে যারা কর্মরত তারা এখনও ফ্যাসিবাদী আমলের। তাই ওইসব রাষ্ট্রে বাংলাদেশ-বিদ্বেষ ঠেকানোর জন্য যা যা করা দরকার তা করছে না। সেক্ষেত্রে দূতাবাসগুলো থেকে তাদের বের করে এনে অভ্যুত্থানের পক্ষের অফিসারদের নিয়োগ করা দরকার। একইসঙ্গে চলমান প্রোপাগান্ডা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের পিআর সেল করা দরকার বলে কিছু রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে বলেও জানান এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব।
বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে, ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা: বর্তমানে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে উল্লেখ করে অতীতের যেকোনও সময়ের চাইতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিরপুর সেনানিবাসে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামে যোগ দিয়ে তিনি এমন আহ্বান জানান। ইংরেজিতে দেওয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক ও কৌশলগতভাবে এখন আমরা কঠিন সময় পার করছি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।’ অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এসময়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শান্তিরক্ষা মিশনসহ বিভিন্ন কাজের জন্য তাদের ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধান উপদেষ্টা সফলতার সঙ্গে কোর্স সম্পন্ন করার জন্য ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২৪ এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স-২০২৪ এ অংশগ্রহণকারী সবাইকে অভিনন্দন জানান। এসময় জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এনডিসির উচ্চমান সম্পন্ন পাঠ্যক্রমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত থাকায় প্রধান উপদেষ্টা সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ বছর ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২৪ এ ৯৫ জন কোর্স মেম্বার অংশ নেন। যার মধ্যে রয়েছেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ৪৬ জন, বেসামরিক প্রশাসনের ১৬ জন এবং ১৮টি বন্ধুপ্রতিম দেশের ৩৩ জন সদস্য। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী থেকে ৫৫ জন কোর্স মেম্বার ‘আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স-২০২৪’ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ