ঢাকা ১২:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

মিয়ানমার প্রসঙ্গ: শান্তির বাণী বনাম পাল্টা জবাব

  • আপডেট সময় : ০৯:৫২:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • ৮৮ বার পড়া হয়েছে

অজয় দাশগুপ্ত : চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভারতের চেয়ে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বেশি নৈকট্য বোধ করি একদা বার্মা, এখনকার মিয়ানমারের সাথেই ছিল। তখন চট্টগ্রামের মানুষ রাজধানী রেঙ্গুন যেতো। ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষত, সোনা ও কাঠের ব্যবসা ছিল জমজমাট। একসময় বার্মিজ নারী বিয়ে করে স্বদেশে নিয়ে আসাও ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের শৈশবে পাড়ায়-মহল্লায় বার্মিজ নারীদের দেখা পাওয়া যেত। সিটি কর্পোরেশন থেকে টিকা দিতে বাড়ি বাড়ি আসা নারীদের বেশ কয়েকজনই ছিলেন সেসময়ের বার্মার বংশোদ্ভুত নারী। এরা তাদের দেশে ফেরত যাননি কোনওদিন। মিয়ানমারের আরাকানের সঙ্গে আমাদের দেশের ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠতা এখনও চট্টগ্রামের গান-কবিতাতে খুঁজে পাই। সেই সময় আঞ্চলিক গানের রানি ও রাজা নামে পরিচিত শেফালী ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব গাইতেন- “এক্কানা মনার গুরগুরি ঠ্যাং কেনে মনা রেঙ্গুম গেল?
হাতের বাঁশি ফেলাই গ্যাল মা বাবারে কাঁদাই গ্যাল।” যার মূলে বিরহ আর বেদনা।
সে সময় বদলে গেছে। বিশেষ করে সামরিক শাসনের দেশ মিয়ানমার আর বার্মা নাই। সে দেশের রাজধানীও এখন নেপিদো। দেশটির মানবিকতার একমাত্র বিজ্ঞাপন হিসেবে পরিচিত শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চিও এখন কারাগার বন্দি। বারবার প্রতিবাদ করতে আসা নিজের নাগরিকদের গুলি করা হত্যা করতেও পিছপা নয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এদের হাতে বৌদ্ধ সন্যাসীরাও অনিরাপদ। তাদের জীবনও গিয়েছে সেনাদের গুলিতে । এমন একটা আগ্রাসী শাসনের দেশ নীতিবাক্য মানবে না এটাই স্বাভাবিক। এতসব ঘটনা বলার কারণ সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকেন। তারপর থেকে থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র দল বিশেষ করে মিয়ানমারের রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে। নতুন করে সংঘাত শুরু হয় গত অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে। শুরুর দিকে বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু, কোনার পাড়া, উত্তর পাড়া ও বাইশফাঁড়িসহ বিভিন্ন সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গোলাগুলির খবর আসছিল। পরে পুরো নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৮ অগাস্ট বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টারে গোলা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে এসে পড়ে। ওই এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই দিনে ও রাতে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে বলে সংবাদমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয়রা বলছেন। মাঝে মধ্যে হেলিকপ্টার ও জেট ফাইটার থেকেও ছোড়া হচ্ছে গোলা।
১৭ সেপ্টেম্বর রাতে মিয়ানমার থেকে আসা গোলা সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরিত হলে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। ওইদিন সকালেই ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে ‘মাইন’ বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশি যুবকের পা উড়ে যায়। সবশেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির কাউকে আর ঢুকতে দেব না। যে পরিমাণ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে রয়েছে, আমরা নিজেরাই এখন তাদের নিয়ে নানা ধরনের জটিলতায় রয়েছি। তাই আর কোনো রোহিঙ্গাকে আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেব না।”
‘মিয়ানমার আমাদের কাঁধে রোহিঙ্গা শরণার্থী চাপিয়ে দিয়েছে’- এ কথা বলে যারা আত্মতুষ্টি লাভ করেন আমি তাদের দলে না। কারণ এর পেছনে ছিল আমাদের কাচা আবেগ, ধর্মীয় উত্তেজনা। আওয়ামী লীগের অজস্র ভালো কাজের পাশাপাশি এই ঢালাও আবেগী সিদ্বান্ত যে কাল হবে সেটা নিয়ে একদল মানুষের মতো আমার মনেও শুরু থেকে শঙ্কা ছিল।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, মিয়ানমারের এমন আগ্রাসনের কারণ বিবিধ। দেশের ভেতর নিজেদের টলটলায়মান অবস্থান আর অসন্তোষ ধামাচাপা দিতে এমনটি করতে পারে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার। আবার অনেকে মনে করেন সেখানকার বিদ্রোহীদের একাংশকে দিয়ে ইচ্ছে করেই এমন করানো হচ্ছে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য।
আরো একধাপ এগিয়ে একাংশ বলেন সেখানে থাকা উগ্রবাদীরাও এমন করতে পারে। যাতে দুই দেশের সীমান্ত সংঘর্ষে তারা তাদের ফায়দা লুটতে পারে। ঘটনা যাই হোক, আমাদের দেশের জন্য এসব একেবারেই সুস্থ বা স্বাভাবিক কিছু না। বরং এতে আমাদের দেশের উন্নতি অগ্রগতিসহ সাধারণ মানুষের জীবন পড়ছে বিপদে। এখনকার বাস্তবতায় কোনও দেশ যুদ্ধে যেতে রাজি হলে বুঝতে হবে, তার ভেতরে অসুবিধা আছে। তার অস্তিত্ব বা চলমানতায় আছে সংকট। রাশিয়া ইউক্রেইনের অস্বাভাবিক হঠাৎ যুদ্ধে দুনিয়া আছে ঘোর বিপাকে।
তেলের দামসহ খাদ্যদ্রব্যের মূল্য এখন আকাশছোঁয়া। এমন দুনিয়ায় মানুষের কষ্টের সীমা নাই। আমাদের দেশেও তার কুপ্রভাব পড়েছে। আমাদের সরকার প্রধানসহ সকলেই মানুষকে সংযমী আর পরিমিত জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এমন কঠিক সময়ে অকারণে একটি যুদ্ধ কতটা খারাপ হতে পারে সেটা সকলেই জানেন।
উস্কানি আর যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব পরিহার করেই আমাদের একটা সমাধান খুঁজে পেতে হবে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘে বিষয়টি তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে। সেটা যতো তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল। বিশ্ব এখন নিজেই অসহায়। এর আগেও আমরা দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশের যুদ্ধ বিগ্রহে জাতিসংঘের কথা শোনেনি কেউ। মানেনি তাদের সুসিদ্বান্ত । তাই সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। আমার যেটা মনে হয় মিয়ানমার এমন একটা সরকারের শাসনে আছে, যারা কারো কথা শোনে না । কূটনৈতিক শিষ্টাচার বা নিয়মও মানে না তারা। আশ্চর্যজনকভাবে তাদের অনিয়ম একনায়কতন্ত্র আর গণতন্ত্রহীনতার পরও আমেরকা বা ইউরোপ নিশ্চুপ। ধারণা করা যায়, অস্ত্র-বাণিজ্য আর আরাকানের খনিজের মোহেই তার গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হিসেবে মিয়ানমারে ওইসব দেশগুলোর উপস্থিতি নাই। কাজেই বাংলাদেশকে সাবধান হতেই হবে। মিয়ানমার যেন ভুলে না যায়, আমাদের জনসংখ্যা কত, যেন তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, আমরা আক্রমণকারী নই কিন্তু আক্রান্ত হলে, আমরাও ছেড়ে কথা বলবো না। মাতৃভূমি ও দেশের স্বাধীনতার জন্য দেশ ও দেশের বাইরের বাংলাদেশিরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা সময় মতো আমাদের সাহস ও শৌর্যের পরিচয় দিতে জানি। এটা যেন মনে করিয়ে দিতে ভুলে না যাই। বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না- এটা বারবার প্রমাণ করার পরও মিয়ানমার কিছুদিন পরপরই উস্কানি কা- ঘটায় । এবারের মাত্রাটা ভিন্ন। যা দেখে পড়ে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে তারা যুদ্ধই চায়। সে কারণে আত্মরক্ষার পাশাপাশি আমাদের স্বাধীনতা সুরক্ষার দায়িত্ব আজ সবচেয়ে জরুরী। দেশমাতৃকার একটি টুকরোও পবিত্র। গোলাবর্ষণ আর আক্রমণ দিয়ে তারা যে ভয়ের আবহ তৈরি করছে, তার পরিবর্তে শান্তির পাশাপাশি আমাদের নিরাপত্তা বিধান আর জবাব দেওয়ার কাজটি করা উচিৎ। সুকান্তের কবিতার লাইন দিয়ে মনে হয় একথা বোঝানো সম্ভব- ‘বাংলার মাটি দুজর্য় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’ শুভ বোধদয়ে নিরাপত্তা ও শান্তি ফিরে আসুক।
লেখক : কলামিস্ট, সিডনি থেকে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

মিয়ানমার প্রসঙ্গ: শান্তির বাণী বনাম পাল্টা জবাব

আপডেট সময় : ০৯:৫২:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

অজয় দাশগুপ্ত : চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভারতের চেয়ে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বেশি নৈকট্য বোধ করি একদা বার্মা, এখনকার মিয়ানমারের সাথেই ছিল। তখন চট্টগ্রামের মানুষ রাজধানী রেঙ্গুন যেতো। ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষত, সোনা ও কাঠের ব্যবসা ছিল জমজমাট। একসময় বার্মিজ নারী বিয়ে করে স্বদেশে নিয়ে আসাও ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের শৈশবে পাড়ায়-মহল্লায় বার্মিজ নারীদের দেখা পাওয়া যেত। সিটি কর্পোরেশন থেকে টিকা দিতে বাড়ি বাড়ি আসা নারীদের বেশ কয়েকজনই ছিলেন সেসময়ের বার্মার বংশোদ্ভুত নারী। এরা তাদের দেশে ফেরত যাননি কোনওদিন। মিয়ানমারের আরাকানের সঙ্গে আমাদের দেশের ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠতা এখনও চট্টগ্রামের গান-কবিতাতে খুঁজে পাই। সেই সময় আঞ্চলিক গানের রানি ও রাজা নামে পরিচিত শেফালী ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব গাইতেন- “এক্কানা মনার গুরগুরি ঠ্যাং কেনে মনা রেঙ্গুম গেল?
হাতের বাঁশি ফেলাই গ্যাল মা বাবারে কাঁদাই গ্যাল।” যার মূলে বিরহ আর বেদনা।
সে সময় বদলে গেছে। বিশেষ করে সামরিক শাসনের দেশ মিয়ানমার আর বার্মা নাই। সে দেশের রাজধানীও এখন নেপিদো। দেশটির মানবিকতার একমাত্র বিজ্ঞাপন হিসেবে পরিচিত শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চিও এখন কারাগার বন্দি। বারবার প্রতিবাদ করতে আসা নিজের নাগরিকদের গুলি করা হত্যা করতেও পিছপা নয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এদের হাতে বৌদ্ধ সন্যাসীরাও অনিরাপদ। তাদের জীবনও গিয়েছে সেনাদের গুলিতে । এমন একটা আগ্রাসী শাসনের দেশ নীতিবাক্য মানবে না এটাই স্বাভাবিক। এতসব ঘটনা বলার কারণ সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকেন। তারপর থেকে থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র দল বিশেষ করে মিয়ানমারের রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে। নতুন করে সংঘাত শুরু হয় গত অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে। শুরুর দিকে বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু, কোনার পাড়া, উত্তর পাড়া ও বাইশফাঁড়িসহ বিভিন্ন সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গোলাগুলির খবর আসছিল। পরে পুরো নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৮ অগাস্ট বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টারে গোলা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে এসে পড়ে। ওই এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই দিনে ও রাতে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে বলে সংবাদমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয়রা বলছেন। মাঝে মধ্যে হেলিকপ্টার ও জেট ফাইটার থেকেও ছোড়া হচ্ছে গোলা।
১৭ সেপ্টেম্বর রাতে মিয়ানমার থেকে আসা গোলা সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরিত হলে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। ওইদিন সকালেই ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে ‘মাইন’ বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশি যুবকের পা উড়ে যায়। সবশেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির কাউকে আর ঢুকতে দেব না। যে পরিমাণ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে রয়েছে, আমরা নিজেরাই এখন তাদের নিয়ে নানা ধরনের জটিলতায় রয়েছি। তাই আর কোনো রোহিঙ্গাকে আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেব না।”
‘মিয়ানমার আমাদের কাঁধে রোহিঙ্গা শরণার্থী চাপিয়ে দিয়েছে’- এ কথা বলে যারা আত্মতুষ্টি লাভ করেন আমি তাদের দলে না। কারণ এর পেছনে ছিল আমাদের কাচা আবেগ, ধর্মীয় উত্তেজনা। আওয়ামী লীগের অজস্র ভালো কাজের পাশাপাশি এই ঢালাও আবেগী সিদ্বান্ত যে কাল হবে সেটা নিয়ে একদল মানুষের মতো আমার মনেও শুরু থেকে শঙ্কা ছিল।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, মিয়ানমারের এমন আগ্রাসনের কারণ বিবিধ। দেশের ভেতর নিজেদের টলটলায়মান অবস্থান আর অসন্তোষ ধামাচাপা দিতে এমনটি করতে পারে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার। আবার অনেকে মনে করেন সেখানকার বিদ্রোহীদের একাংশকে দিয়ে ইচ্ছে করেই এমন করানো হচ্ছে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য।
আরো একধাপ এগিয়ে একাংশ বলেন সেখানে থাকা উগ্রবাদীরাও এমন করতে পারে। যাতে দুই দেশের সীমান্ত সংঘর্ষে তারা তাদের ফায়দা লুটতে পারে। ঘটনা যাই হোক, আমাদের দেশের জন্য এসব একেবারেই সুস্থ বা স্বাভাবিক কিছু না। বরং এতে আমাদের দেশের উন্নতি অগ্রগতিসহ সাধারণ মানুষের জীবন পড়ছে বিপদে। এখনকার বাস্তবতায় কোনও দেশ যুদ্ধে যেতে রাজি হলে বুঝতে হবে, তার ভেতরে অসুবিধা আছে। তার অস্তিত্ব বা চলমানতায় আছে সংকট। রাশিয়া ইউক্রেইনের অস্বাভাবিক হঠাৎ যুদ্ধে দুনিয়া আছে ঘোর বিপাকে।
তেলের দামসহ খাদ্যদ্রব্যের মূল্য এখন আকাশছোঁয়া। এমন দুনিয়ায় মানুষের কষ্টের সীমা নাই। আমাদের দেশেও তার কুপ্রভাব পড়েছে। আমাদের সরকার প্রধানসহ সকলেই মানুষকে সংযমী আর পরিমিত জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এমন কঠিক সময়ে অকারণে একটি যুদ্ধ কতটা খারাপ হতে পারে সেটা সকলেই জানেন।
উস্কানি আর যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব পরিহার করেই আমাদের একটা সমাধান খুঁজে পেতে হবে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘে বিষয়টি তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে। সেটা যতো তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল। বিশ্ব এখন নিজেই অসহায়। এর আগেও আমরা দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশের যুদ্ধ বিগ্রহে জাতিসংঘের কথা শোনেনি কেউ। মানেনি তাদের সুসিদ্বান্ত । তাই সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। আমার যেটা মনে হয় মিয়ানমার এমন একটা সরকারের শাসনে আছে, যারা কারো কথা শোনে না । কূটনৈতিক শিষ্টাচার বা নিয়মও মানে না তারা। আশ্চর্যজনকভাবে তাদের অনিয়ম একনায়কতন্ত্র আর গণতন্ত্রহীনতার পরও আমেরকা বা ইউরোপ নিশ্চুপ। ধারণা করা যায়, অস্ত্র-বাণিজ্য আর আরাকানের খনিজের মোহেই তার গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হিসেবে মিয়ানমারে ওইসব দেশগুলোর উপস্থিতি নাই। কাজেই বাংলাদেশকে সাবধান হতেই হবে। মিয়ানমার যেন ভুলে না যায়, আমাদের জনসংখ্যা কত, যেন তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, আমরা আক্রমণকারী নই কিন্তু আক্রান্ত হলে, আমরাও ছেড়ে কথা বলবো না। মাতৃভূমি ও দেশের স্বাধীনতার জন্য দেশ ও দেশের বাইরের বাংলাদেশিরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা সময় মতো আমাদের সাহস ও শৌর্যের পরিচয় দিতে জানি। এটা যেন মনে করিয়ে দিতে ভুলে না যাই। বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না- এটা বারবার প্রমাণ করার পরও মিয়ানমার কিছুদিন পরপরই উস্কানি কা- ঘটায় । এবারের মাত্রাটা ভিন্ন। যা দেখে পড়ে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে তারা যুদ্ধই চায়। সে কারণে আত্মরক্ষার পাশাপাশি আমাদের স্বাধীনতা সুরক্ষার দায়িত্ব আজ সবচেয়ে জরুরী। দেশমাতৃকার একটি টুকরোও পবিত্র। গোলাবর্ষণ আর আক্রমণ দিয়ে তারা যে ভয়ের আবহ তৈরি করছে, তার পরিবর্তে শান্তির পাশাপাশি আমাদের নিরাপত্তা বিধান আর জবাব দেওয়ার কাজটি করা উচিৎ। সুকান্তের কবিতার লাইন দিয়ে মনে হয় একথা বোঝানো সম্ভব- ‘বাংলার মাটি দুজর্য় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’ শুভ বোধদয়ে নিরাপত্তা ও শান্তি ফিরে আসুক।
লেখক : কলামিস্ট, সিডনি থেকে।