ঢাকা ০১:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারতে নতুন সরকার ও বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যু

  • আপডেট সময় : ১০:১৯:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ জুন ২০২৪
  • ৩১ বার পড়া হয়েছে

মোস্তফা হোসেইন : ভারতে মাসব্যাপী লোকসভা নির্বাচনি উৎসব শেষে বিজয়ী জোটনেতা নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন সরকারের শুভ সূচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণও সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের এই নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনকালীন রাজনীতি এবং ফলাফল পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপেই বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে গণ্য হতে পারে।
দেশটির নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সবসময়ই প্রশংসনীয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। নির্বাচন কমিশন যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেখানে গড়ে উঠেছে, এর পেছনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে সে দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো। তারা ঐকমত্য পোষণ করেন– গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে এই প্রতিষ্ঠানকে দন্তহীন বাঘে পরিণত করা যাবে না। তারা আন্তরিকভাবে সেটা মেনেও চলে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের যে আস্থা কতটা, মাসব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার প্রমাণ মেলে। আবার সব নির্বাচনের ফল একসঙ্গে প্রকাশ, তাও মাসাধিককাল আগে শুরু হওয়া নির্বাচনের ফল, এটি আসলেও ব্যতিক্রমী দিক।
আমাদের দেশে যদি রাত ১২টায় একটি কেন্দ্রের আংশিক ফল প্রকাশ হয়, বাকি অংশ প্রকাশে যদি কালবিলম্ব ঘটে তখনই রাজনৈতিক দলগুলোর চিৎকার শুরু হয়ে যায়। তারা মনে করে সংসদীয় আসনের নির্দিষ্ট আসনে ভোটের ফল প্রকাশে কারচুপি হচ্ছে। অথচ ভারতে একমাসও অপেক্ষা করতে হয় নির্বাচনি ফল প্রকাশের জন্য। প্রায় ৯০ কোটি ভোটারের নির্বাচনে সংঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা নেই দুটিও। নির্বাচন মানি না, মানবো না কোনও স্লোগানও নেই। কংগ্রেস জোট ‘ইন্ডিয়া’ মোদি সরকারকে অভিনন্দন না জানালেও চুপ থেকে নির্বাচনি ফলাফল মেনে নিয়েছে। যেমনি মেনে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসও। যদিও তারা নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাননি। পেলেও যেতেন বলে মনে হয় না।
এই বিশাল যজ্ঞের পেছনে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সেখানকার জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো। তারা নিজেদের দলীয় স্বার্থের চেয়ে তাদের সংবিধানকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ভারতে অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে ভোটাররা এবার ভোট দিয়েছেন। এটা মূলত দেশাত্মবোধ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থার কারণেই সম্ভব হয়েছে। ওখানকার বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, গণমাধ্যম সবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে নির্বাচনে।
রাজনৈতিক দলগুলো লড়াইয়ের মানসিকতা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। এই যে বিজেপি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তারা তাদের মাত্র দুই জন প্রার্থীর বিজয় মাধ্যমে যাত্রা করে। আজকে তাদের অবস্থান কত দৃঢ় হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে সর্বভারতীয় দল হিসেবে ভারতীয় কংগ্রেস গত নির্বাচনেও বিশাল ব্যবধানে হেরে গিয়ে দমে যায়নি। এবার সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও গত নির্বাচনে যে অবস্থান ছিল তার চেয়ে অনেক দূর এগিয়েছে তারা। তারা এখন বিরোধী দলের আসনে বসবে, পুরো মেয়াদ তাদের বিরোধীদলীয় দায়িত্ব পালন করবে। ইভিএম নিয়ে অহেতুক মাতামাতি করা নির্বাচন বর্জন করার সংস্কৃতি তাদের মধ্যে নেই। নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে একটি দলও বলেনি তারা কোনও ইস্যুতে নির্বাচন বর্জন করছে।
এবারের নির্বাচনে ভারতীয় জনগণের মানসিকতাও বিশ্লেষণ হতে পারে। বিজেপি যেভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা করে ভারতীয়দের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে, মনে হয় সেক্ষেত্রে তারা ততটা সফল হয়নি। বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির ইস্যুকে তারা কাজে লাগাতে পারেনি এটা বোঝা গেলো। ওখানকার গণমাধ্যমগুলোর প্রায় সবই বড় বড় ব্যবসায়ীদের দখলে। তাদের আবার রাজনৈতিক সংযোগ আছে প্রায় সবারই। কিন্তু নির্বাচনে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল একান্তই প্রফেশনাল।
ওখানকার প্রতিটি অংশীজনের দায়িত্ববোধ ছিল ইতিবাচক। যে কারণে নির্বিঘ্নে এত বড় একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এবং বিতর্কহীনভাবে সম্পন্ন হতে পেরেছে।
নতুন ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজেপির নির্বাচনি দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার কারণে সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি পরিবর্তন হতে পারে, এ নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেই ধারাবাহিকতা কি অব্যাহত থাকবে? বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা এবং কোথাও কোথাও সরাসরি সংখ্যালঘুদের প্রতি বিরূপ মন্তব্যের বিষয়টি নির্বাচনি প্রচারণাকালে দেখা গেছে। এর বিনিময়ে তাদের আশা ছিল ৪ শতাধিক আসনে বিজয়ী হওয়া। ধর্ম ব্যবহার করে যে সুবিধা হয়নি সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। আগামীতে কি তারা ধর্ম ব্যবহার অব্যাহত রাখবেন? জোটবদ্ধ সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কোনও কোনও নেতা এমনও মন্তব্য করেছেন, জোটবদ্ধ সরকারের ক্ষণস্থায়িত্ব তাদের পরবর্তী সরকার গঠনের আশা জাগায়। এক্ষেত্রে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারার প্রশ্ন আসে। ইতোমধ্যে মোদি সরকারে সমঝোতার ভিত্তিতে মন্ত্রিত্ব প্রদান করা হয়েছে। এই সমঝোতা টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। কারণ জোটভুক্ত ছোট দলগুলোর দরকষাকষির জায়গা কমে এসেছে। সুতরাং মোদি সরকার ক্ষমতা হারাবে এমন আশঙ্কা কমই মনে হচ্ছে।
ভারতের নতুন সরকারে বাংলাদেশ সম্পর্কে কি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয়? এমন প্রশ্ন আসাও অস্বাভাবিক নয়। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চান, এটা আগেও প্রমাণ হয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যে সুসম্পর্ক রক্ষায় মোদি সরকার অধিক মনোযোগী তার প্রমাণ হিসেবে শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণের মধ্য দিয়েও বোঝা যায়। তবে পাকিস্তান প্রশ্নে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয় নরেন্দ্র মোদিকে ভাবতে হবে। বিশেষ করে তিস্তা পানি চুক্তি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। তার বিগত মেয়াদকালে এর একটি সুষ্ঠু সুরাহা হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাস্তবে তা হয়নি। নতুন মেয়াদে তার কতটা বাস্তবায়ন হবে তা দেখার বিষয়।
অন্যদিকে গঙ্গাচুক্তিরও নবায়ন করতে হবে চলতি মেয়াদে। গঙ্গার পানির প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের মতো বিহারেরও স্বার্থ জড়িত আছে। নবায়নকালে নতুন কোনও ফেঁকড়া তৈরি হয় কিনা সেটাও আগাম বলা যাচ্ছে না। সীমান্তে হত্যা বন্ধে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও এটা কার্যকর হয়নি। নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানের দিনও কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার জামতলায় একজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় বিএসএফ।
বাংলাদেশ জন্ম থেকেই ভারতকে বন্ধু মনে করে। বর্তমান ভারত সরকারই শুধু নয়, বিরোধী দলও বাংলাদেশের পক্ষের। এবারের নির্বাচনে ভারতীয় কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করেছে। তার মানে তাদের পার্লামেন্টে সরকারি ও বিরোধীদল নির্বিশেষে বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দুই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে ভাবা যেতেই পারে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

 

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ভারতে নতুন সরকার ও বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যু

আপডেট সময় : ১০:১৯:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ জুন ২০২৪

মোস্তফা হোসেইন : ভারতে মাসব্যাপী লোকসভা নির্বাচনি উৎসব শেষে বিজয়ী জোটনেতা নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন সরকারের শুভ সূচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণও সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের এই নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনকালীন রাজনীতি এবং ফলাফল পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপেই বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে গণ্য হতে পারে।
দেশটির নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সবসময়ই প্রশংসনীয়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। নির্বাচন কমিশন যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেখানে গড়ে উঠেছে, এর পেছনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে সে দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো। তারা ঐকমত্য পোষণ করেন– গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে এই প্রতিষ্ঠানকে দন্তহীন বাঘে পরিণত করা যাবে না। তারা আন্তরিকভাবে সেটা মেনেও চলে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের যে আস্থা কতটা, মাসব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার প্রমাণ মেলে। আবার সব নির্বাচনের ফল একসঙ্গে প্রকাশ, তাও মাসাধিককাল আগে শুরু হওয়া নির্বাচনের ফল, এটি আসলেও ব্যতিক্রমী দিক।
আমাদের দেশে যদি রাত ১২টায় একটি কেন্দ্রের আংশিক ফল প্রকাশ হয়, বাকি অংশ প্রকাশে যদি কালবিলম্ব ঘটে তখনই রাজনৈতিক দলগুলোর চিৎকার শুরু হয়ে যায়। তারা মনে করে সংসদীয় আসনের নির্দিষ্ট আসনে ভোটের ফল প্রকাশে কারচুপি হচ্ছে। অথচ ভারতে একমাসও অপেক্ষা করতে হয় নির্বাচনি ফল প্রকাশের জন্য। প্রায় ৯০ কোটি ভোটারের নির্বাচনে সংঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা নেই দুটিও। নির্বাচন মানি না, মানবো না কোনও স্লোগানও নেই। কংগ্রেস জোট ‘ইন্ডিয়া’ মোদি সরকারকে অভিনন্দন না জানালেও চুপ থেকে নির্বাচনি ফলাফল মেনে নিয়েছে। যেমনি মেনে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসও। যদিও তারা নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাননি। পেলেও যেতেন বলে মনে হয় না।
এই বিশাল যজ্ঞের পেছনে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সেখানকার জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো। তারা নিজেদের দলীয় স্বার্থের চেয়ে তাদের সংবিধানকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ভারতে অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে ভোটাররা এবার ভোট দিয়েছেন। এটা মূলত দেশাত্মবোধ এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থার কারণেই সম্ভব হয়েছে। ওখানকার বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, গণমাধ্যম সবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে নির্বাচনে।
রাজনৈতিক দলগুলো লড়াইয়ের মানসিকতা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। এই যে বিজেপি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তারা তাদের মাত্র দুই জন প্রার্থীর বিজয় মাধ্যমে যাত্রা করে। আজকে তাদের অবস্থান কত দৃঢ় হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে সর্বভারতীয় দল হিসেবে ভারতীয় কংগ্রেস গত নির্বাচনেও বিশাল ব্যবধানে হেরে গিয়ে দমে যায়নি। এবার সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও গত নির্বাচনে যে অবস্থান ছিল তার চেয়ে অনেক দূর এগিয়েছে তারা। তারা এখন বিরোধী দলের আসনে বসবে, পুরো মেয়াদ তাদের বিরোধীদলীয় দায়িত্ব পালন করবে। ইভিএম নিয়ে অহেতুক মাতামাতি করা নির্বাচন বর্জন করার সংস্কৃতি তাদের মধ্যে নেই। নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে একটি দলও বলেনি তারা কোনও ইস্যুতে নির্বাচন বর্জন করছে।
এবারের নির্বাচনে ভারতীয় জনগণের মানসিকতাও বিশ্লেষণ হতে পারে। বিজেপি যেভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা করে ভারতীয়দের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে, মনে হয় সেক্ষেত্রে তারা ততটা সফল হয়নি। বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির ইস্যুকে তারা কাজে লাগাতে পারেনি এটা বোঝা গেলো। ওখানকার গণমাধ্যমগুলোর প্রায় সবই বড় বড় ব্যবসায়ীদের দখলে। তাদের আবার রাজনৈতিক সংযোগ আছে প্রায় সবারই। কিন্তু নির্বাচনে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল একান্তই প্রফেশনাল।
ওখানকার প্রতিটি অংশীজনের দায়িত্ববোধ ছিল ইতিবাচক। যে কারণে নির্বিঘ্নে এত বড় একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এবং বিতর্কহীনভাবে সম্পন্ন হতে পেরেছে।
নতুন ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজেপির নির্বাচনি দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার কারণে সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি পরিবর্তন হতে পারে, এ নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেই ধারাবাহিকতা কি অব্যাহত থাকবে? বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা এবং কোথাও কোথাও সরাসরি সংখ্যালঘুদের প্রতি বিরূপ মন্তব্যের বিষয়টি নির্বাচনি প্রচারণাকালে দেখা গেছে। এর বিনিময়ে তাদের আশা ছিল ৪ শতাধিক আসনে বিজয়ী হওয়া। ধর্ম ব্যবহার করে যে সুবিধা হয়নি সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। আগামীতে কি তারা ধর্ম ব্যবহার অব্যাহত রাখবেন? জোটবদ্ধ সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কোনও কোনও নেতা এমনও মন্তব্য করেছেন, জোটবদ্ধ সরকারের ক্ষণস্থায়িত্ব তাদের পরবর্তী সরকার গঠনের আশা জাগায়। এক্ষেত্রে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারার প্রশ্ন আসে। ইতোমধ্যে মোদি সরকারে সমঝোতার ভিত্তিতে মন্ত্রিত্ব প্রদান করা হয়েছে। এই সমঝোতা টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। কারণ জোটভুক্ত ছোট দলগুলোর দরকষাকষির জায়গা কমে এসেছে। সুতরাং মোদি সরকার ক্ষমতা হারাবে এমন আশঙ্কা কমই মনে হচ্ছে।
ভারতের নতুন সরকারে বাংলাদেশ সম্পর্কে কি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয়? এমন প্রশ্ন আসাও অস্বাভাবিক নয়। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চান, এটা আগেও প্রমাণ হয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যে সুসম্পর্ক রক্ষায় মোদি সরকার অধিক মনোযোগী তার প্রমাণ হিসেবে শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণের মধ্য দিয়েও বোঝা যায়। তবে পাকিস্তান প্রশ্নে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয় নরেন্দ্র মোদিকে ভাবতে হবে। বিশেষ করে তিস্তা পানি চুক্তি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। তার বিগত মেয়াদকালে এর একটি সুষ্ঠু সুরাহা হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাস্তবে তা হয়নি। নতুন মেয়াদে তার কতটা বাস্তবায়ন হবে তা দেখার বিষয়।
অন্যদিকে গঙ্গাচুক্তিরও নবায়ন করতে হবে চলতি মেয়াদে। গঙ্গার পানির প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের মতো বিহারেরও স্বার্থ জড়িত আছে। নবায়নকালে নতুন কোনও ফেঁকড়া তৈরি হয় কিনা সেটাও আগাম বলা যাচ্ছে না। সীমান্তে হত্যা বন্ধে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও এটা কার্যকর হয়নি। নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানের দিনও কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার জামতলায় একজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় বিএসএফ।
বাংলাদেশ জন্ম থেকেই ভারতকে বন্ধু মনে করে। বর্তমান ভারত সরকারই শুধু নয়, বিরোধী দলও বাংলাদেশের পক্ষের। এবারের নির্বাচনে ভারতীয় কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করেছে। তার মানে তাদের পার্লামেন্টে সরকারি ও বিরোধীদল নির্বিশেষে বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দুই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে ভাবা যেতেই পারে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।