নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বাজারগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু দোকানে যদিওবা পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর মূল্য ঘষে তুলে ফেলা বা মূল্য দেখা গেলেও সে তুলনায় বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে প্রতিদিনই ক্রেতা-বিক্রেতারা বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজারে ঘোরাঘুরি করে খোলা তেল কিনেই বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের অভিযোগ, একটি গোষ্ঠী যোগসাজশ করে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য সংকট তৈরি করছে। আর, বিক্রেতাদের ভাষ্য, কোম্পানিগুলো থেকেই সরবরাহ কম।
শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর নিকেতন ও মহাখালী কাঁচাবাজারে কয়েকটি দোকান ঘুরেও ১ লিটার বা ২ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া যায়নি। এই বাজারের মায়ের দোয়া স্টোর্সের সামনে বচসা হচ্ছিল ক্রেতা-বিক্রেতার। ক্রেতার ভাষ্য, বোতলের দাম ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে। ১ লিটারের সয়াবিন তেল তিনি দুদিন আগেও কিনেছেন ১৬৩ টাকায়। সেই বোতলের দাম ঘষে তুলে ফেলে বিক্রেতা ১৭০ টাকা চাইছেন। এ সময় বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, আমি কাল সন্ধ্যায় এই মাল আনছি। কারওয়ান বাজার থেকে। এখন আনছিই এভাবে। এছাড়া নাই। কিনাও অন্য সময়ের চাইতে বেশি। তাই ১৭০ টাকা করেই বিক্রি করতে হইতেছে।
সেখানে তেল কিনতে আসা শাহরিয়ার মাহমুদ নামের এক ক্রেতা বলেন, এগুলো আসলে ঠিক না। ওই যে হয় না, হঠাৎ একট জিনিস নাই করে দিয়ে দাম বাড়িয়ে ফেলার যে ব্যাপারটা, ওইরকম আরকি। এটা শুরু হইছিল হাসিনার আমলে। এখনও ব্যবসায়ীরা সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন!
রাজধানীর মিরপুরের মুসলিম বাজারে পাঁচটি মুদি দোকান ঘুরে দুই লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে পেরেছেন সত্তরোর্ধ্ব সায়ীদ মালিক। তা-ও গায়ের দামের চেয়ে ৬ টাকা বেশি দিয়ে কিনেছেন ৩৪০ টাকায়। রূপনগর এলাকার এই বাসিন্দা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সয়াবিন তেলের জন্য দোকানে দোকানে ঘুরতে হলো। বাজারে তেল নাই, এটা তো বাসায় বোঝে না। যেভাবেই হোক তেল নিতে হবে। তেল না থাকলে রান্না হবে না। পরিচিত দোকানেও তেল পেলাম না।’
শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) সকালে যারা বাজারে গেছেন ভোজ্যতেল না পেয়ে তাদের অনেকেই হতাশ। অনেকে খালি হাতেই ফিরছেন বাসায়। হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে মিলছে দু-একটি কোম্পানির সয়াবিন তেল। সেখানেও হাঁকানো হচ্ছে বাড়তি দাম। মিরপুরের মুসলিম বাজার, ১১ নম্বর কাঁচাবাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। একই অবস্থা ঢাকার অন্য খুচরা বাজারগুলোতেও। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কম। বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট সবচেয়ে বেশি। ফলে বিক্রেতারা পর্যাপ্ত তেল পাচ্ছেন না। কোনো কোনো বিক্রেতার অভিযোগ, রমজান মাস শুরুর আগে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আরও এক দফা দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করে নিতে চাইছে কোম্পানিগুলো। সয়াবিন তেলের এই সংকটের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায় দিলেন নিকেতন কাঁচাবাজারের মুদি দোকানি নিরঞ্জন সাহা। তিনি বলেন, সামনে রমজান মাস। সেটাকে সামনে রেখে বাজারে কিছুটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, যাতে দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করা যায়। পরে মহাখালী কাঁচাবাজারে গেলে মুদি দোকানি আবদুর রহমান বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কম। এর মধ্যে বোতলজাত ১ বা ২ লিটার সয়াবিন তেলের সংকট বেশি। এজন্য আমরা পর্যাপ্ত তেল পাচ্ছি না। বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, রূপচাঁদা এক লিটার সয়াবিন তেলের গায়ের দাম ১৬৭ টাকা, দুই লিটার বোতলের গায়ের দাম ৩৩৪ টাকা ও পাঁচ লিটার ৮১৮ টাকা। কিন্তু, বেশিরভাগ দোকানে এ দামের চেয়ে অন্তত ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি নিচ্ছেন বিক্রেতারা। বাজারে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্প্রতি পাম ও সয়াবিন তেল আমদানিতে প্রতি কেজিতে শুল্ক-কর ১০ থেকে ১১ টাকা কমানো হয়। বিক্রেতারা বলছেন, শুল্ক কমলেও সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল লিটারপ্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে খোলা পাম অয়েল ১৬০-১৬২ টাকা এবং সয়াবিন ১৭০-১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ ও প্রচার) আফরোজা রহমান জানান, ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশে আলু, পেঁয়াজ, চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বাজার তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকায় ভোক্তা অধিকারের ৫টি টিম কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিলাররা তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। তেল কেনার জন্য আটা-ময়দার বস্তা কেনার শর্তজুড়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে তেল সরবরাহ কমেছে বলে দাবি তেল আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারের হিসাবে লিটারে ১০-১৩ টাকা বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের মতো। তবে আমদানিকারকদের এমন দাবির সঙ্গে একমত নন ভোক্তারা। সানমুন নামের একজন ক্রেতা বলেন, তেল আমদানি হয়েছে তিন-চার মাসে আগে। অথচ এখন বলা হচ্ছে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। এটি আসলে অযৌক্তিক কথা। তিনি বলেন, কর ও শুল্ক কমানোর পরও তেলের দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। এখন আবার নতুন করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। সরকারের শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তাসলিম গণমাধ্যমে জানান, সরকার শুল্ক-কর যা কমিয়েছে, তার চেয়ে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে বেশি। কোম্পানিগুলো লোকসানের ঝুঁকিতে থাকলেও সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে সরবরাহ বাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক বেড়েছে। স্থানীয় বাজারে দাম বাড়াতে আমরা ১০ দিন আগে ট্যারিফ কমিশনের কাছে চিঠি দিয়েছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত এলে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবো। কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক-কর কমানো মানে ওই পণ্যের আমদানি বাড়বে এবং দাম কমবে। গত অক্টোবরে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ক-কর কমায় সরকার। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক-কর কমিয়ে তা নামিয়ে আনা হয় ৫ শতাংশে। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যটির দাম কমার বিপরীতে উল্টো বাড়তে দেখা যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে এই আমদানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার টন। সে হিসাবে আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এ ছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে এবার আমদানিকারকের সংখ্যাও কমেছে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ