মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন : সম্প্রতি দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে খুবই উদ্বেগজনক একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী ‘২০৩০ সালে দাবদাহে ষষ্ঠ শীর্ষ নগরী হবে ঢাকা। এটা যে কত বড়ো একটি ভয়ানক খবর তা যারা এই গত এপ্রিলের দাবদাহ অতিক্রম করেছেন তারা স্পষ্টতই বুঝতে পারবেন ২০৩০ সালে ঢাকা তথা সারা দেশের পরিস্থিতি কী হতে পারে। এটা ভাবলেই গা শিউরে উঠতে হয়। কী কঠিন সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বিদেশি পত্রিকায় ২০৩০ সালের একটি সম্ভাব্য তাপমাত্রা উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় দুবাইয়ের তাপমাত্রা হবে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তারপরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে কায়রো ৪২.২, নয়া দিল্লি ৪১.১, ব্যাঙ্কক ৩৮.৪, জাকার্তা ৩৭.৮ ও ঢাকা ৩৭.২। এটা অবশ্যই ভয়াবহ রকম অশনিসংকেত। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হতে পারে বিশ্বের ষষ্ঠতম গরমের নগরী। এতে বাছাই করা দাবদাহের শিকার ২৫টি শহরের তালিকায় ছয় নম্বরে থাকবে ঢাকা। এটা অবশ্যই কোনো আনন্দের খবর নয়। চলতি বছর ২০২৪ সালের গরমেই মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোক করে ছটফট করতে করতে মানুষ মারা যাচ্ছিল। চারিদিকে গরম বাতাস বইছিল। সারা দিন বাইরে কাজ করে এসে ঘরে গিয়ে ফ্যান ছাড়লে ফ্যান থেকে আসতো উত্তপ্ত লু হাওয়া। যাদের সামর্থ্য ছিল তারা এসি কিনতে তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সুযোগ বুঝে এসি ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ১৫/২০ হাজার টাকা করে। বিরাট ব্যবসা হয়েছে মানুষের বিপদে। অবশ্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা মানুষের বিপদের দিনে ঝুপ বুঝে কূপ মেরে ব্যবসা করে নেয়। তাহলে কী যে দারুণ ব্যবসা হবে ২০৩০ সালে। তখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আশা করা যায় আরো বাড়বে। এসি চালালে ঘরের ভেতরে ঠাণ্ডা হয় ঠিকই। কিন্তু একই সাথে এসিগুলোর আউটডোর ইউনিটগুলো প্রচুর পরিমাণে তাপ নিঃসরণ করে। বাইরের পরিবেশকে আরো গরম করে তোলে। ২০২৪ সালে এপ্রিল মাস ছিল বাংলাদেশে বিগত ৪৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শুষ্ক ও উষ্ণতম মাস। এই মাসে সর্বোচ্চ গড় মাপমাত্রার রেকর্ড ছিল ৩৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ডিগ্রি বেশি। এই তাপমাত্রা বিগত ৭৬ বছরের মধ্যে সব চেয়ে বেশি। দেশব্যাপী যে দীর্ঘ দাবদাহ বয়ে গেছে তাতে রাজধানীবাসীর ভোগান্তির মাত্রা ওপরের দিকেই ছিল। সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত থাকবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মিসরের কায়রো, ভারতের নয়াদিল্লি, থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক ও ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা। এর পরেই থাকবে বাংলাদেশের শহর ঢাকা। স্বাভাবিক নিয়মে একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫% গাছপালা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকার কথা। বাংলাদেশে এটা নেই। কোনোকালে এটা ছিল বলেও জানা যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট আয়তনের কত ভাগ বনভূমি রয়েছে এটার সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয় এটা কোনো ক্রমেই ১০% এর অধিক নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবল চাপ সামলাতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে নিত্য দিনই ফসলী জমি হারিয়ে যাচ্ছে। কাটা পড়ছে মূল্যবান বৃক্ষ সম্পদ।
১৯৯০ সালের পর রাজধানী ঢাকার ব্যাপকতা (পরিধি ও জনসংখ্যা) প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল সোনালি ধানের ক্ষেত সেখানে এখন বহুতল আবাসিক ভবন। কিন্তু কোনো গাছপালা নেই। নেই কোনো জলাশয়। ফলে সূর্যের কঠোর কিরণ সরাসরি মাটিতে পড়ে। বিল্ডিংয়ের ছাদে পড়ে। দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে যায় এগুলো। অথচ প্রচুর গাছপালা থাকলে গাছের পাতাগুলোই তাপ শোষণ করে নিতো। গাছও সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে খাদ্র উৎপাদন করতে পারতো। একই সাথে ঢাকা শহরে লেক, খাল, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। নগরে জলাশয় থাকলে সেগুলো সূর্যের তাপের বিরাট একটা অংশ শোষণ করে নিতে পারে। ফলে প্রকৃতি থাকে অনেকটাই শীতল। ঢাকা শহরে এখন বড় কোনো জলাশয় নেই বললেই চলে। রমনা পার্কের লেক, ধানমন্ডি লেক, গুলশান লেক এগুলো বাদ দিলে জলাশয় আর কোথায়? বুড়িগঙ্গা নামের যে নদীটি ছিল তাকে খুন করা হয়েছে। একই সাথে অসহায় হয়ে পড়েছে মানুষ ও অন্যান্য জীব।
আপনি কি শহরে বাস করেন? কিংবা গ্রামে? আপনি যে এলাকায় বসবাস করেন সে এলাকায় কি প্রচুর পরিমাণে গাছপালা আছে? না কি একেবারেই গাছপালা নেই? আপনার এলাকায় যদি প্রচুর পরিমাণে গাছপালা থাকে তাহলে আপনি অবশ্যই ভাগ্যবান এবং ভবিষ্যতের নাগরিকরা যদি ভাগ্যবান হতে চায় তাহলে আপনার উচিত হবে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা লাগানো ও তাদের যত্ন নেওয়া এবং যেকোনো প্রতিকূল অবস্থা থেকে তাদেরকে রক্ষা করা। আপনার এলাকায় যদি কোনো গাছ না থাকে তাহলে এটা কোনো আনন্দের কথা নয়। যেকোনো এলাকাতেই মানুষকে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণে গাছ থাকতে হবে। সেটা হতে পারে কাঠের গাছ, ফলের গাছ, ফুলের গাছ, কিংবা মিশ্র প্রকৃতির গাছ। গাছ ছাড়া জীবনের চিন্তা করাটাই বোকামি। ঢাকা শহরে কয়টি গাছ আছে? পুরো বাংলাদেশে কতগুলো গাছ আছে? ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মানুষ আছে তাতে করে ঢাকা শহরে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ কোটি গাছ থাকা দরকার।
দেশে মানুষ আছে প্রায় ১৮ কোটি। জন প্রতি ১০টি গাছ থাকলেও দেশে প্রায় ২০০ কোটির উপর বৃক্ষ থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু গাছ। গাছ লাগাতে হবে মন থেকে, হৃদয় থেকে। গাছের যত্ন নিতে হবে প্রাণ খুলে। গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের সকলের স্বার্থে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার বৈচিত্র্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু ছিল। কাব্য করে বলা হতো বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। অথচ এখন বাংলাদেশে কোনো ঋতুগত বৈচিত্র্য নাই। সারা দেশে চলছে দারুণ খরা। কোনো বৃষ্টি নেই। চারিদিকে যেন একটু বৃষ্টির জন্য হাহাকার। মানুষ প্রচণ্ড গরমে যেন হাসফাস করে। আবার অতিবৃষ্টির কারণে রাজধানীসহ সারা দেশের অনেক পথঘাট তলিয়ে যায় এক সময়। সাগরে নিম্নচাপজনিত বৃষ্টির কারণে দেখা দেয় ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ সবই আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে ঘটছে। সকলে জলবায়ুর পরিবর্তন বলে যে কথাটার ওপর জোর দিচ্ছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ তারই ফল। আমরা কি জানি, গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াও এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি প্রধান কারণ। রাজধানী ঢাকা শহরে কয়টা গাছ আছে? কতগুলো গাছ থাকা উচিত ছিল? জানি, আমার প্রশ্নের জবাব সবারই জানা। তাপ শুষে নিতে যে পরিমাণ গাছপালা থাকা দরকার তার ঘাটতি ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, সবুজের অভাব, ভবনের অসম উচ্চতা ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সব মিলিয়ে শহুরে তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই হার পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও নগর অবকাঠামোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে প্রতিনিয়ত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক, ৩১শে মার্চ ২০২৪ থেকে অনেক দিন পর্যন্ত সারা দেশে টানা তাপপ্রবাহ চলেছে। ১৯৪৮ সাল থেকে কখনো এত দিন টানা তাপপ্রবাহ ছিল না। গত ২৯শে এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর, আদাবর ও ধানমণ্ডি সব চেয়ে উষ্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। এই এলাকাগুলোতে বৃক্ষরাজি ও জলাশয় নেই বললেই চলে।
সব মিলিয়ে এই ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ এলাকার মানুষ দাবদাহের কারণে ঝুঁকিতে থাকে প্রায় সারা বছর। সামনের দিনগুলোতে তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়ই বেশি হারে তাপমাত্রা বেড়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এ ছাড়া যান চলাচলসহ বিভিন্ন কারণে বায়ুদূষণ, মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ বৃদ্ধি ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায়ও তাপ বাড়ছে। এর ফলে গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ মেয়াদী হচ্ছে, বর্ষাকাল দেরি করে আসছে। দাবদাহের কারণেই বিভিন্ন জীবাণুর বেঁচে থাকা এমনকি নতুন রূপে ফিরে আসার প্রবণতা বাড়ছে। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাণ-প্রকৃতিতে বড়ো ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। অতি উষ্ণতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা দূর করতে হলে সারা পৃথিবীবাসীকে একযোগে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে অনেকগুলো রাষ্ট্র থাকলেও পুরো পৃথিবীটা একটা বৃহৎ গ্রাম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সুবিশাল গ্রাম আমাদের সকলের। একে আমাদের স্বার্থে, অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
গবেষণায় দেখা যায়- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তনটা ঘটেছে তাপ ও শৈত্যপ্রবাহে। আমরা জানি, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে তাকে তাপপ্রবাহ ধরা হয়। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি বা এর নিচে নামলে তাকে ধরা হয় শৈত্যপ্রবাহ। গত মে-জুনে দেশে ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে তীব্র তাপপ্রবাহ বজায় থেকেছে। তখন একের পর এক জারি করা হচ্ছিল তীব্র তাপ্রবাহের রেড এলার্ট। চারদিকে অসনীয় গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় একেবারে যেন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ছিল তখন। বলা যায় এ বছরের তীব্র এই তাপপ্রবাহে জনজীবন একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না- আবহাওয়ার এই বৈরী পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তনেরই ফল। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এই বৈরী পরিস্থিতি আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়বে ছাড়া কমবে না। সুতরাং এখনই যদি বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সর্বোচ্চ সচেতনতা তৈরি না হয় তাহলে এ ধরিত্রি সত্যি-সত্যি বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এই বিরূপ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে কার্বন নিঃসরণ, অপরিকল্পিত বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতাকে দূর করার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, লৌহজং মহাবিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ