প্রত্যাশা ডেস্ক : বিশ্বের ধনী ও অতিধনীদের সম্পদ বেড়েই চলেছে। অক্সফামের বৈষম্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল থেকে বিশ্বের যত সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশ গেছে বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীদের ঘরে। একই সময় বাকি ৯৯ শতাংশের ঘরে গেছে অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ। পরিসংখ্যানের এখানেই শেষ নয় – গত এক দশকে বিশ্বে যত সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তার অর্ধেক চলে গেছে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে।
অক্সফামের সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট শীর্ষক এই প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক দাভোস সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে প্রকাশ করা হয়েছে। এমন এক সময় শীর্ষ ধনীদের সম্পদ বেড়েছে, যখন বিশ্বে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে—এ নিয়ে সারা বিশ্বেই আলোচনা হয়েছে। দেশে দেশে নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ করেছে। তাতেও একই চিত্র পাওয়া গেছে – অর্থাৎ নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার খানিকটা কমছিল। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি আবার থমকে গেছে। বাস্তবতা হলো, গত ২৫ বছরের মধ্যে এই তিন বছর চরম দরিদ্র ও অতিধনীর সংখ্যা একইভাবে বেড়েছে।
বৈষম্য প্রসঙ্গে তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা দুই বিঘা জমির দুটি লাইন উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক হতে পারে: ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’
অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে শীর্ষ ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। তথ্যানুসারে, ৯৫টি খাদ্য ও জ্বালানি কোম্পানির মুনাফা ২০২২ সালে স্রেফ দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর তাদের সম্মিলিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৬ বিলিয়ন বা ৩০ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার তারা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মুনাফা কয়েক গুণ বেড়েছিল।
মহামারির সেই সময়ে মানুষের প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে তা হয়েছিল। ঘর থেকে অফিস করা, ভার্চ্যুয়াল বৈঠক ও ক্লাসের কল্যাণে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর রমরমা অবস্থা হয়েছিল। ওয়ালমার্টের মালিক ওয়ালটন পরিবার গত বছর ৮৫০ কোটি ডলার মুনাফা পেয়েছে। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ভারতের গৌতম আদানির সম্পদ সম্প্রতি তরতরিয়ে বেড়েছে। গত বছর তাঁর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৪২ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার। হঠাৎ কোনো এক বছরে কোম্পানির এই অতি মুনাফা ’উইন্ডফল প্রফিট’ হিসেবে পরিচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমতাবাদীদের দাবি, এসব কোম্পানির ওপর উইন্ডফল ট্যাক্স আরোপ করা হোক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আয়কর দিয়েছেন মাত্র ৩ শতাংশ হারে। অথচ উগান্ডার আটা বিক্রেতা অ্যাবার ক্রিস্টিন মাসে ৮০ ডলার আয় করলেও আয়কর দেন ৪০ শতাংশ হারে।
সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো, প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্তত অর্ধেক হয়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর এই অতি মুনাফার প্রবণতার কারণে। বলা হয়েছে, এসব দেশে যথাক্রমে ৫৪ শতাংশ, ৫৯ শতাংশ ও ৬০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে করপোরেটদের উচ্চ মুনাফার কারণে। স্পেনের অন্যতম বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন সিসিওও বলছে, ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকে দেশটির মূল্যস্ফীতির ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে করপোরেটদের উচ্চ মুনাফার কারণে। অথচ এমন এক সময় তা হয়েছে, যখন বিশ্বের প্রায় ১৭০ কোটি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। অর্থাৎ তাঁদের প্রকৃত মজুরি কমেছে। প্রায় ৮২ কোটি মানুষ ক্ষুধাপেটে ঘুমাতে যাচ্ছে এবং এই জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই হলো নারী ও মেয়ে শিশু। বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের অর্ধেকই তারা।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভবত গত তিন বছর অসমতা সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলো এখন স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে চারগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করছে ঋণ পরিশোধে। তিন-চতুর্থাংশ দেশ কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করেছে। আগামী পাঁচ বছর এসব দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জরুরি খাতে ৭৮০ কোটি ডলার ব্যয় হ্রাস করতে হবে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ব্যয় কমানোর কারণে এসব দেশের পরবর্তী প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈষম্য আরও বাড়বে। অথচ আইএমএফ-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা ঋণ দেওয়ার আগে যেসব শর্ত দেয়, সেসব শর্ত পূরণ করতে যেয়ে ঋণগ্রহীতা দেশের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। কিন্তু আইএমএফের লক্ষ্য একটাই, কীভাবে ঋণ ফেরত পাওয়া যাবে।
বিশ্বে অতিদরিদ্র ও অতিধনী একই সঙ্গে বেড়েছে : অক্সফামের

Read Time:7 Minute, 33 Second