সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : বড় বড় কর্তাদের পুকুরচুরি থেকে ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি, ছোট-বড় চুরি-ডাকাতি থেকে কেনাবেচায় টাকা আত্মসাৎ, কর ফাঁকি, হরেক রকম দুর্নীতি ঘটেই চলেছে চার পাশে। কর ফাঁকি দেওয়া, ব্যবসার আইনি কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও প্রভূত রোজগার করা, ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের চাঁদাবাজি, দেদারসে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার নানা গল্পের মাঝেই বাজেট আসছে।
বাজেট কি দুর্নীতি বিরোধী হয়? সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রধান অগ্রাধিকার। সেই মূল্যস্ফীতি যাতে না বাড়ে সে লক্ষ্যে অপচয় ও দুর্নীতি কমানোই বড় পদক্ষেপ। আমাদের বাজেটের অন্যতম কাঠামোগত সমস্যা হলো আয়ের চাইতে ব্যয় বেশি। দুর্নীতি এবং অপচয়ের কারণে সরকারের ব্যয় বাড়ে এবং অতিরিক্ত ব্যয় বাজেটের ঘাটতি বাড়িয়ে দেয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্র্য়া ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদে। আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত এ বাজেট উপস্থাপন হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ কখনোই ছিল না।
ডলার সংকট, ডলারের উচ্চমূল্য আর বৈদেশিকমুদ্রার রিজার্ভ সংকটে বেসামাল অর্থনীতি। এর মধ্যেই বাজেট দিতে হচ্ছে সরকারকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি, যথাযথভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া, রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি ও এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, বৈধ পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে জোর থাকছে বাজেটে।
বাজেট আসে, কয়েকদিন মানুষ কোন জিনিসের দাম বাড়ল আর কমল এ নিয়ে আলোচনার পর বাজেটের কথা ভুলে যায় সবাই। বাজেট কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়না, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়না, সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়তেই থাকে, পরোক্ষ কর নির্ভর হয়ে চলতে হয় সরকারকে। কিন্তু কোনো কিছুর জন্য কোথাও কেন জবাবদিহিতার প্রয়োজন হয় না।
এখন বেশ কয়েকজন বড় শেঠের দুর্নীতি আলোচনায়। কিন্তু বাস্তবে দুর্নীতি সম্বন্ধে আমরা বহু ক্ষেত্রেই উদাসীন। দুর্নীতির কালিমাখা টাকার একটা বড় অংশ যে আমাদের দেশের জাতীয় আয়ের এবং জাতীয় ব্যয়ের বিরাট অংশ জুড়ে রাজত্ব করছে, সে কথাটা আমাদের বিব্রত করে না। যে টাকা বিদেশে চলে গেল সেসব যে আর ফিরে আসেনা তা নিয়ে আমরা উদাসীন থাকি।
পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের অস্বাভাবিক দুর্নীতি নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা। কিন্তু যখন তিনি দায়িত্বে ছিলেন রাষ্ট্র যে তখন এগুলো দেখেও দেখে নাই সেটাই শাসন ব্যবস্থার সংকট। আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো পূরণ করার দায়িত্ব যাদের হাতে, তাদের অধিকাংশই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তখন অন্যদের মনে দুর্নীতিতে জড়িত থেকে ধরা পড়ার ভয় কমে যেতে থাকে। বাংলাদেশে এখন সেটাই ঘটছে।
বেনজীরের নজিরবিহীন দুর্নীতির আলোচনাতেই জানা গেল জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) একজন নিম্নমান সহকারী আকরাম হোসেনের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে গত ১৫ বছরে জমা হয় ১২৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। একই সময়ে তুলে নেওয়া হয় ১২৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে ব্যবসা দেখানো হলেও ব্যাংকিং লেনদেন করেছেন স্বামী।
ঢাকায় এই দম্পতির আছে একাধিক ফ্ল্যাট, দোকান ও জমি। ঢাকার বাইরে নাটোরে আছে বাড়ি ও জমি। কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও জমি কেনা হয়েছে। সাভারের বিরুলিয়ায় আছে সাড়ে ছয়তলা বাণিজ্যিক ভবন। আরও অনেক অনেক সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী এখন এমন পাওয়া যাবে। একটা অবাধ লুটপাট চলছে সর্বত্র।
সরকারের হাতে নগদ টাকার সংকট। কিন্তু সরকারী কর্মী, কিছু ব্যবসায়ী এবং শাসক দলীয় কিছু লোকের হাতে বিপুল অর্থ সম্পদ। এক কথায় বলা যায় দুর্নীতির বড় শিকার দরিদ্ররাই। অসীম দুর্নীতি যে সরকারি কর্মকর্তারা করেন তারাই শাসন ব্যবস্থাকে স্বৈরাচারী করে রাখেন।
দুর্নীতির সবচেয়ে বড় শিকার দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষ। সরকারি যে সেবা নিখরচায় ও নিঃশর্তে পাওয়া উচিত, সেই প্রতিটি সেবার জন্য তাদের সঙ্গতির বাইরে গিয়ে মূল্য দিতে হয়। যারা সে মূল্য দিতে পারছেন না, তারা অনন্তকাল ধরে ভুগছেন। মানুষকে এসব ছোটখাট দুর্নীতির সঙ্গে অভ্যস্ত করে রেখে বড় দুর্নীতির বিরাট ভুবন তৈরি করেছেন বড় আমলা, রাজনীতিক আর ব্যবসায়ীরা।
দুর্নীতি সমাজে বিশাল শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করছে। প্রান্তিক শ্রেণির যতটা শোষণ হয় এই দুর্নীতির জন্য, ততটা অন্য কোনও আর্থসামাজিক শ্রেণির মানুষের হয় না। বাংলাদেশে উন্নয়ন সবচাইতে উচ্চারিত শব্দ। বড় বড় প্রকল্পের আবরণে সব দুর্নীতি ঢাকার একটা চেষ্টা আছে।
শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জীবন মান উন্নয়নের যে স্বপ্ন মানুষকে দেখানো হয়েছিল, তা চুরমার হয়ে গিয়েছে, এবং তারা বুঝছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে শ্রেণি-উত্তরণের সুযোগ তাদের নেই। উন্নয়নখাতের টাকা নয়ছয় হলে সবচেয়ে ক্ষতি হয় প্রান্তিক শ্রেণির মানুষেরই, কারণ সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের উপরে তাদের নির্ভরতাই সর্বাধিক। এবার রিমাল ঘূর্ণিঝড়ে বেরি বাঁধ ভেসে যাওয়া কি সে কথাই বলে না?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল।