সরকারের আয় ব্যয়ের পরিকল্পনা বা বাজেট শিশুদের নিয়ে থাকে না আলাদা কোনো ভাবনা। তবে অনেক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিশুদের কাছে যায়। যেমন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বেশিরভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মসূচি ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা গর্ভবতী অথবা স্তন্যদানকারী মায়েদেরকে কেন্দ্র করে সামাজিক নিরাপত্তা বা স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদি।
সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময় শিশুদের বিকাশের কথা বলা হয়, কিন্তু সুযোগ সুবিধার অভাবও স্পষ্ট। আবার বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব বলছে, সারা দেশে অভিভাবকহীন পথ শিশুর সংখ্যা ৩৪ লাখের মত। তাদের তিন ভাগের এক ভাগের মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত নেই। প্রাথমিকে শতভাগ শিশুকে ভর্তির যে লক্ষ্য, সেখানেও এই শিশুরা বাদ পড়ে যাচ্ছে। কারণ জরিপে দেখা গেছে পথশিশুদের ৭১ শতাংশের বেশি নিরক্ষর। এদের জীবন বিকশিত হচ্ছে না, কিশোর বয়সে জড়াচ্ছে মাদক আর অপরাধে, ভবিষ্যতে সামাজিক নিরাপত্তাও পড়ছে হুমকিতে। পৃথক বরাদ্দ ও প্রকল্প না থাকায় এই শিশুদের জীবন মান উন্নয়নের কার্যকর কিছু করা যাচ্ছে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যে তৎপরতা, তা পৌঁছতে পারছে না তাদের কাছে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক নামে সরকারের একটি মন্ত্রণালয় আছে যাদের কাজ নারী ও শিশুদের কল্যাণে কাজ করা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীর কাছে চাহিদাপত্র দিলেও এই মন্ত্রণালয় থাকে নীরব।
মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, “শিশুদের জন্য আলাদা বাজেটের প্রস্তাব করিনি আমরা। তবে আমরা শিশুদের বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক বিকাশের নতুন নতুন প্রজেক্ট নিচ্ছি। আলাদা বাজেট একটু টাইম লাগবে, হয়ত ধীরে ধীরে সেদিকে যাওয়া হবে।”
বাজেটে শিশুদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কত টাকা বরাদ্দ থাকছে তা দেখার জন্য জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন করা পর্যন্ত অপেক্ষার পরামর্শ এই সরকারি কর্মকর্তার। আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে প্রায় আট লাখ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব রেখে বাজেট উপস্থাপন করতে পারেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাজেটে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় থাকতে পারে সাড়ে ১৪ লাখ থেকে ১৫ লাখ মানুষ, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ১৩ লাখ ৪ হাজার। উপকারভাগী এই সংখ্যা নিতান্তই কম। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য খাতের আওতায় শিশুরা সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে যেসব সহায়তা পায়, এর বাইরেও আলাদা শিশু বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ রাখার দাবি জানিয়েছেন শিশু অধিকার ফোরামের প্রধান মাহবুবুল হক।
বলেন, “২০১৫ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাস্তায় কোনো শিশু থাকবে না; কিন্তু এটা বাস্তবায়ন হয়নি। শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। পথশিশুরা মাদকের বাহন হচ্ছে, গ্যাং তৈরি করছে- কারণ তাদের বাবা-মা গরিব বা দেখার কেউ নেই।
“পথ শিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ভাতার আওতায় নিয়ে আসা উচিত রাষ্ট্রের। এর ফলে তারা স্কুলমুখি হবে। এ জন্য তো আলাদা বাজেট লাগবে।”
জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ শিশু, সুবিধাবঞ্চিতরাও সংখ্যায় বিপুল: জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ওয়েবসাইট অনুযায়ী বাংলাদেশে জনগোষ্ঠীর ৩৩ শতাংশই শিশু। তাদের সংখ্যাটি পৌনে ৬ কোটির কাছাকাছি। সরকার প্রতি অর্থবছরের শুরুতে আয় ব্যয়ের যে পরিকল্পনা তৈরি করে, সেখানে সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা সহায়তা, স্কুল ফিডিং, উপবৃত্তি, টিকাদান, বিনামূল্যে বই বিতরণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য খাতের ব্যয় বরাদ্দে শিশুরা উপকারভোগী। তবে পরিবারের বাইরে রাস্তার ধারে, পার্কে যেসব শিশু বড় হচ্ছে, তাদের কাছে এসব প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছে না বললেই চলে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সীমিত পরিসরে কার্যক্রম অভিভাবকহীন এই শিশুদের বেড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করতে পারছে না।
চলতি বছর সরকারের ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) ফেজ-২’ প্রকল্পের অধীনে পথশিশুদের পরিস্থিতি বিষয়ে যে গবেষণা করা হয়েছে, তাতে উঠে এসেছে, দেশে পথ শিশুদের সংখ্যা কমপক্ষে ৩৪ লাখ।
ইউনিসেফের সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২ বলছে, পথ শিশুদের ৩০.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১০ লাখের বেশি রাস্তাঘাট, স্টেশন, টার্মিনাল, মাঠ বা পার্কে ঘুমায়। তাদের প্রায় ৭২ শতাংশ বা প্রায় ২৫ লাখ পড়তে বা লিখতে পারে না। রাস্তায় বসবাসকারী শিশুদের প্রায় ৮৩ শতাংশ বা ২৮ লাখের বেশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় পথচারীদের দ্বারা। প্রায় অর্ধেক শিশু কাজের জায়গায় সহিংসতার শিকার। সরকার, পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ২০১৯ সালে করা ‘প্রগতির পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ১১ শতাংশের বেশি শিশুশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বা উভয় ক্ষেত্রে নিয়োজিত। ৮ শতাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হলেও এখনো ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হচ্ছে ৫১ শতাংশের বেশি মেয়েদের। ১৫ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে তাদের বয়স ১৫ হওয়ার আগেই।
সরকারের জেন্ডার বাজেট, শিক্ষা সংক্রান্ত বাজেট, সংস্কৃতি, খেলাধুলা বা এ ধরনের উপখাতগুলোর মত শিশুদের উন্নয়নে বাজেটে আলাদা কোনো আলোচনা বা ব্যয় পরিকল্পনা না থাকায় সুনির্দিষ্টভাবে এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করা যাচ্ছে না। কর্মজীবী নারীদের সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র না থাকা, এমনকি সন্তানদের স্তন্যপানের জন্য আলাদা জায়গা না থাকাও শিশুদের বিকাশের পথে বড় অন্তরায়। এসব বিষয়ও বাজেটের আলোচনায় উপেক্ষা করা হয়।
পরোক্ষ বরাদ্দও অনুপাতে কমছে: আন্তর্জাতিক শিশু সহায়তা সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছে, চলতি (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে সরাসরি সুবিধা বা পরোক্ষ সুবিধা মিলিয়ে শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেটা ছিল ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ চার বছর আগের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমেছে। সংস্থাটির শিশু বিষয়ে বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা জাফর সিদ্দিকী বলছেন, “দিনদিন বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ কমে আসছে। সেটা বাড়ানো প্রয়োজন। শিশুদের জন্য ইনভেস্ট করতে পারলে বড় রিটার্ন আসবে। ভালো লিডার তৈরি হবে, দক্ষ নাগরিক তৈরি হবে।”
২০২৩ সালে সেভ দ্য চিলড্রেন বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখেছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রয়েছে মূল বাজেটের ১৬/১৭ শতাংশ। সেখানে শিশুদের জন্য সরাসরি বরাদ্দ ৭ শতাংশের নিচে।
জাফর সিদ্দিকী বলেন, “শিশুদের জন্য যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিশুদের সরাসরি সুবিধা আছে, এমন সব জায়গায় বাজেটের বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। বরাদ্দ হলে শুধু হবে না সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে। এটাকে একটা জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার।”
২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাজেটে শিশুদের জন্য ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার লক্ষ্য ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এত বছরেও এর কাছাকাছি পৌঁছানো হচ্ছে না। এর বড় একটা কারণ হলো শিক্ষা-স্বাস্থ্যে যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সেটার বাস্তবায়নই তো হচ্ছে না।
“আমরা বাল্যবিয়ে রোধ করতে পারছি না, শিশুশ্রম কমাতে পারছি না- ঠিক জায়গামত বোধ হয় হাত দিতে পারছি না। শিশুর বাজেটের মাধ্যমে সরকার যদি এ জায়গাতে কাজ করে তাহলে অবশ্যই সমস্যাগুলো সমাধান সম্ভব হবে। একটা ফ্রেমওয়ার্ক থাকা দরকার।”
সুবিধাবঞ্চিতদের মূল স্রোতে নিয়ে আসতেই হবে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, “শিশুদের একটা বড় অংশই সুবিধাবঞ্চিত; যাদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। “প্রত্যেকটা শিশুই গুরুত্বপূর্ণ। কার ভেতরে কী আছে সেটা বলা যাবে না। একটা বড় অংশ অনাহারে, অনাদরে, অবাঞ্ছিতভাবে বেড়ে ওঠে। ছোট ছোট বাচ্চারা ফুল বিক্রি করছে, গাড়ি মুছে দিচ্ছে, নেশায় চলে যাচ্ছে, থাকার জায়গা নেই, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই শিশুদের জন্য সরকারের দায়িত্ব আছে তাদের সহযোগিতা করার। তাদেরকে স্কুলে পাঠদান করানোর দায়িত্বও রয়েছে।” বর্তমান সরকারের বিনামূল্যে বই বিতরণ, মিড ডে মিল ইত্যাদি কর্মসূচিতে দেশে সামাজিক পরিবর্তন এসেছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে মেনে নিলেও অধ্যাপক জিনাত হুদা মনে করেন, আরও অনেক দূর যেতে হবে। তিনি বলেন, “এখন একজন গৃহকর্মীও চায় মেয়েকে পড়াতে, আগে বিয়ে দিয়ে দিত। মেধাশক্তি তৈরি, দক্ষ নাগরিক তৈরি, স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির জন্য যে জনশক্তি দরকার সেটার জন্যও তো এই অর্থটা দরকার।
“জাতীয় বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাত আর শিশুদের জন্য। খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান- এই চারটা জিনিস ছোটবেলা থেকে না দিতে পারলে একজন কখনোই স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান, মেধাবী হিসেবে গড়ে উঠবে না।”
শিশুদের বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত খেলার জায়গা ও উপকরণ নিশ্চিত করা – এমন খাতেও বরাদ্দ চাইছেন সমাজবিজ্ঞানের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, “এমন মাঠ-পার্ক করা উচিত যেখানে ছিন্নমূল, তৃণমূল পর্যায়ে বিনা পয়সায় যেতে পারবে। সুতরাং তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো উচিত বলেই মনে করি।”
সুবিধাহীন পরিবারে নবজাতকের জন্য দুধ, কাপড়সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ে সহায়তা, প্রান্তিক শিশুদের খাতা, পোশাক নিশ্চিত করা, মাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন পাঠ্যক্রমে খরচ বেড়ে যাওয়ায়, এই পর্যায়েও প্রান্তিক শিশুদের জন্য আলাদা নজর চাইছেন অধ্যাপক জিনাত। তিনি বলেন, “তাদের প্রচুর ড্রয়িং করতে হচ্ছে, অনেক জিনিসপত্র তৈরি করতে হচ্ছে- একটা প্রান্তিক পরিবারের বাবা-মা তো খেতেই দিতে পারে না- সে তার বাচ্চাকে এত পেন্সিল, রাবার, রং এসব কোত্থেকে কিনে দেবে?”
সেভ দ্য চিলড্রেন কর্মকর্তা জাফর সিদ্দিকী বলেন, “স্বাস্থ্যখাতের আওতায় শিশুদের টিকা দেওয়া হয়, কিন্তু এ জায়গাটায় কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। পুষ্টির জায়গাটাতেও ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। “শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখন যদি পুষ্টির প্রয়োজনটা মেটানো না হয় তাহলে তাদের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সে জায়গাটাতে বড় কাজ করার জায়গা আছে।” দেশের অনেক শিশু সাঁতার না শিখে ডুবে মারা যাচ্ছে, সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানেও কর্মসূচি গ্রহণে বাজেটে বরাদ্দ চাইছেন তিনি। সূত্র: বিডিনিউজ