ঢাকা ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক হান কাংয়ের উপন্যাসে মানবিকতা

  • আপডেট সময় : ০৫:০৬:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ১৭ বার পড়া হয়েছে

গাজী মিজানুর রহমান : দক্ষিণ কোরিয়ার লেখিকা হান কাং ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ৫৩ বছর বয়সী হান এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ১৮তম নারী, যিনি সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এই পুরস্কার জিতলেন। দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন হান তার প্রতিটি গ্রন্থে দক্ষিণ কোরিয়াবাসীর দুঃখ-যন্ত্রণার কথা এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন।
ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে যেসব মানুষ নানাভাবে বঞ্চিত, বিশেষভাবে নারীরা, তাদের হান কাং সহমর্মিতার জায়গা থেকে তার লেখায় এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে তার গদ্য কাব্যের চরিত্র পেয়েছে। নোবেল কমিটির মতে, কাব্যময় গদ্য কোরিয়ান সাহিত্যে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সউল থেকে ২৬৯ কিলোমিটা দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গোয়াংজু সিটিতে ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর হান কাং জন্মগ্রহণ করেন। হান এর বয়স যখন ৯ বছর তখন তিনি পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন-সহ সউল মহানগরীতে এসে বসবাস শুরু করেন।
হান পরিবারের প্রায় সবাই লেখক। পিতা হান সাং ওয়ান ও ভাই হান ডং-রিম দুজনেই তার মতো ঔপন্যাসিক। অপর ভ্রাতা হান কাং-ইন একজন কার্টুনিস্ট ও ঔপন্যাসিক। সউলের ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হান কাং কোরিয়ান ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি সাংবাদিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর সউল ইন্সটিটিউট অব আর্টস এর সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার প্রথম পরিচয় তিন লেখক।
হান কাংয়ের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি ২০১৫ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডেবোরা স্মিথ। এটা তাকে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার এনে দেয়। একরাতে ভীতিকর এক স্বপ্ন দেখে ইয়াং হাই নামের এক কর্মজীবী বিবাহিত নারী মাছ-মাংস ছেড়ে শুধু সবজি খেতে শুরু করেন। শুধু এই কারণে একজন নারী পরিবারের অন্যদের অত্যাচারের লক্ষ্যে পরিণত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান।
উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীদের নিষ্পেষিত জীবনের একটি দিনিলিপি। প্রকারান্তরে ইয়াং হাই এর গল্প জাপানী শাসনের সময় অসংখ্য নারীকে ‘কম্ফোর্ট উম্যান’ হিসেবে নিপীড়িত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।
হান কাংয়ের দ্বিতীয় উপন্যাস হিউম্যান এক্টস ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। গোয়াংজু গণহত্যার স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে এই উপন্যাস রচিত। ১৯৮০ সালের মে মাসের ১৮ তারিখ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত হানের জন্মশহর, দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে তখনকার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-মিছিল সংঘটিত হয়। সামরিক শাসক চান ডু হোয়ানের সশস্ত্র বাহিনী প্রায় ২৩০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে।
হান কাংয়ের পরিবার গোয়াংজুর যে বাড়িতে থাকতেন, সেটা বিক্রয় করে তারা সউলে চলে এসেছিলেন মে মাসের ঘটনার আগেই। সেই বাড়ি কিনেছিল যে পরিবার, তাদের ছেলে কাং ডং হো অন্যদের সাথে এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রাণ হারায়। গণহত্যায় জীবন হারানো এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে যাওয়া আর-কয়েকজন মানুষের কথা নিয়ে উপন্যাসটির গল্প বিস্তার লাভ করেছে ।
১৯৪৮-৪৯ সালে জেজু দ্বীপে যে বর্বরতা চালায় তৎকালীন সরকারের সশস্ত্র বাহিনী, তার ওপর ভিত্তি করে হান কাং এর অপর উপন্যাস ‘উই ডু নট পার্ট ( ২০২১)’ রচিত হয়েছে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র—একজন লেখিকা ও তার বান্ধবী। বান্ধবী ইনসনের অনুরোধে জেজু দ্বীপে তার আটকে থাকা সাদা রঙের পোষা পাখিটাকে বাঁচাতে যায় লেখিকা কিয়ংহা। সেখানে গিয়ে জেজু দ্বীপের দুঃখজনক অতীত ইতিহাস জানতে পারেন তিনি। জেজু দ্বীপের বাসিন্দারা সে সময়কার নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হয় এবং জেজু দ্বীপবাসীর ওপর বীভৎস নির্যাতন নেমে আসে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো প্রথম দিকে এই বাড়াবাড়ি ধামাচাপা দিলেও পরে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায় জাতির কাছে। বন্ধুর পরিবারটিও ওই নির্যাতনের শিকার ছিল, যে স্মৃতি তারা বয়ে চলেছে। ‘উই ডু নট পার্ট’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু এই ঘটনা।
হান কাংয়ের অপর দুই গ্রন্ত ‘দ্য হোয়াইট বুক’ (২০১৮) ও ‘দ্য গ্রিক লেসেনস’ ( ২০২৩) মানবজীবনের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা বলে। প্রিয়জন হারানোর পর নিঃসঙ্গ জীবনের কুরে খাওয়া দুঃখ দুই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। তারা সীমাহীন দুর্দশার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতিগত ইতিহাস খুবই করুণ। জাপানি পীড়নমূলক শাসন শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। তারপর আবার ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধে নানারূপ আপদ নেমে আসে। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকালীন সামরিক শাসন দেশটিকে নিস্পেষিত করে দেয়। এই সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন, গুম, ক্রস-ফায়ার চলেছে বিনা বাধায়। এসবের বিরুদ্ধে আগুয়ান ছাত্র জনতার আন্দোলনে শত শত তাজা প্রাণ ঝরে যায়। পঙ্গু হয় অগণিত মানুষ।
হান কাংয়ের ইতিহাসের এই কালো দিকটি তার উপন্যাস সমূহে তুলে ধরেছেন। তিনি মানবতার পক্ষের মানুষ, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণÑ নোবেল প্রাইজ ঘোষিত হলে হান কাংকে যখন একটা আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনার কথা বলা হয় তখন তিনি বলেন, ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেনে যেভাবে মানুষ মারা হচ্ছে, তাতে তিনি এমন সংবর্ধনার কথা ভাবতেই পারেন না।
নোবেল কমিটির মতে হান কাংকে পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে তার ‘সুতীব্র কাব্যময় গদ্যের জন্য; যা ইতিহাসের সংকটকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুর দিকটি উন্মোচিত করে।’
কাব্যময় গদ্যের একটা উদাহরণ তার হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাস থেকে নেয়া যেতে পারে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত অসংখ্য মানুষের লাশ আনা হয়েছে এক শরীর-চর্চা কেন্দ্রের চত্বরে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী একজন নারী বললেন, ‘ভাই ও বোনেরা, আমাদের ভালোবাসার ধন শহীদদের দেহগুলিকে রেড ক্রস হাসপাতাল থেকে আজ এখানে আনা হচ্ছে।’ এ কথা বলে তিনি সেই স্কয়ারে জড় হওয়া জনতাকে সাথে নিয়ে একটি সমবেত জাতীয় সংগীত গাইলেন। তার কণ্ঠস্বর অতি দ্রুত শতকণ্ঠে হারিয়ে গেল। একটা কণ্ঠস্বরের ওপর হাজারটা কণ্ঠস্বরের ভিত রচিত হলো। এটা ছিল ধ্বনি সমষ্টির এক সুউচ্চ অট্টালিকা; যা আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। গানের লহরি একেবারে চূড়ায় উঠে পেন্ডুলামের মতো ধীরে ধীরে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। আমাদের অন্য সবার কণ্ঠ সেই কণ্ঠের সমুদ্রে হারিয়ে যায় (অনুবাদ এই প্রবন্ধকারের)।
হান কাংয়ের দেশের সঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনের সংগ্রামী চেতনার প্রভূত মিল থাকায় আমরা তার অমর সৃষ্টির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল হবোÑ এটাই কাম্য।

লেখক: সাবেক যুগ্ম সচিব ও লেখক
৫৮

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দাভোসে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক হান কাংয়ের উপন্যাসে মানবিকতা

আপডেট সময় : ০৫:০৬:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

গাজী মিজানুর রহমান : দক্ষিণ কোরিয়ার লেখিকা হান কাং ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ৫৩ বছর বয়সী হান এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ১৮তম নারী, যিনি সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এই পুরস্কার জিতলেন। দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন হান তার প্রতিটি গ্রন্থে দক্ষিণ কোরিয়াবাসীর দুঃখ-যন্ত্রণার কথা এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন।
ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে যেসব মানুষ নানাভাবে বঞ্চিত, বিশেষভাবে নারীরা, তাদের হান কাং সহমর্মিতার জায়গা থেকে তার লেখায় এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে তার গদ্য কাব্যের চরিত্র পেয়েছে। নোবেল কমিটির মতে, কাব্যময় গদ্য কোরিয়ান সাহিত্যে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সউল থেকে ২৬৯ কিলোমিটা দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গোয়াংজু সিটিতে ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর হান কাং জন্মগ্রহণ করেন। হান এর বয়স যখন ৯ বছর তখন তিনি পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন-সহ সউল মহানগরীতে এসে বসবাস শুরু করেন।
হান পরিবারের প্রায় সবাই লেখক। পিতা হান সাং ওয়ান ও ভাই হান ডং-রিম দুজনেই তার মতো ঔপন্যাসিক। অপর ভ্রাতা হান কাং-ইন একজন কার্টুনিস্ট ও ঔপন্যাসিক। সউলের ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হান কাং কোরিয়ান ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি সাংবাদিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর সউল ইন্সটিটিউট অব আর্টস এর সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার প্রথম পরিচয় তিন লেখক।
হান কাংয়ের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি ২০১৫ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডেবোরা স্মিথ। এটা তাকে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার এনে দেয়। একরাতে ভীতিকর এক স্বপ্ন দেখে ইয়াং হাই নামের এক কর্মজীবী বিবাহিত নারী মাছ-মাংস ছেড়ে শুধু সবজি খেতে শুরু করেন। শুধু এই কারণে একজন নারী পরিবারের অন্যদের অত্যাচারের লক্ষ্যে পরিণত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান।
উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীদের নিষ্পেষিত জীবনের একটি দিনিলিপি। প্রকারান্তরে ইয়াং হাই এর গল্প জাপানী শাসনের সময় অসংখ্য নারীকে ‘কম্ফোর্ট উম্যান’ হিসেবে নিপীড়িত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।
হান কাংয়ের দ্বিতীয় উপন্যাস হিউম্যান এক্টস ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। গোয়াংজু গণহত্যার স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে এই উপন্যাস রচিত। ১৯৮০ সালের মে মাসের ১৮ তারিখ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত হানের জন্মশহর, দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে তখনকার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-মিছিল সংঘটিত হয়। সামরিক শাসক চান ডু হোয়ানের সশস্ত্র বাহিনী প্রায় ২৩০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে।
হান কাংয়ের পরিবার গোয়াংজুর যে বাড়িতে থাকতেন, সেটা বিক্রয় করে তারা সউলে চলে এসেছিলেন মে মাসের ঘটনার আগেই। সেই বাড়ি কিনেছিল যে পরিবার, তাদের ছেলে কাং ডং হো অন্যদের সাথে এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রাণ হারায়। গণহত্যায় জীবন হারানো এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে যাওয়া আর-কয়েকজন মানুষের কথা নিয়ে উপন্যাসটির গল্প বিস্তার লাভ করেছে ।
১৯৪৮-৪৯ সালে জেজু দ্বীপে যে বর্বরতা চালায় তৎকালীন সরকারের সশস্ত্র বাহিনী, তার ওপর ভিত্তি করে হান কাং এর অপর উপন্যাস ‘উই ডু নট পার্ট ( ২০২১)’ রচিত হয়েছে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র—একজন লেখিকা ও তার বান্ধবী। বান্ধবী ইনসনের অনুরোধে জেজু দ্বীপে তার আটকে থাকা সাদা রঙের পোষা পাখিটাকে বাঁচাতে যায় লেখিকা কিয়ংহা। সেখানে গিয়ে জেজু দ্বীপের দুঃখজনক অতীত ইতিহাস জানতে পারেন তিনি। জেজু দ্বীপের বাসিন্দারা সে সময়কার নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হয় এবং জেজু দ্বীপবাসীর ওপর বীভৎস নির্যাতন নেমে আসে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো প্রথম দিকে এই বাড়াবাড়ি ধামাচাপা দিলেও পরে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায় জাতির কাছে। বন্ধুর পরিবারটিও ওই নির্যাতনের শিকার ছিল, যে স্মৃতি তারা বয়ে চলেছে। ‘উই ডু নট পার্ট’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু এই ঘটনা।
হান কাংয়ের অপর দুই গ্রন্ত ‘দ্য হোয়াইট বুক’ (২০১৮) ও ‘দ্য গ্রিক লেসেনস’ ( ২০২৩) মানবজীবনের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা বলে। প্রিয়জন হারানোর পর নিঃসঙ্গ জীবনের কুরে খাওয়া দুঃখ দুই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। তারা সীমাহীন দুর্দশার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতিগত ইতিহাস খুবই করুণ। জাপানি পীড়নমূলক শাসন শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। তারপর আবার ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধে নানারূপ আপদ নেমে আসে। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকালীন সামরিক শাসন দেশটিকে নিস্পেষিত করে দেয়। এই সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন, গুম, ক্রস-ফায়ার চলেছে বিনা বাধায়। এসবের বিরুদ্ধে আগুয়ান ছাত্র জনতার আন্দোলনে শত শত তাজা প্রাণ ঝরে যায়। পঙ্গু হয় অগণিত মানুষ।
হান কাংয়ের ইতিহাসের এই কালো দিকটি তার উপন্যাস সমূহে তুলে ধরেছেন। তিনি মানবতার পক্ষের মানুষ, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণÑ নোবেল প্রাইজ ঘোষিত হলে হান কাংকে যখন একটা আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনার কথা বলা হয় তখন তিনি বলেন, ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেনে যেভাবে মানুষ মারা হচ্ছে, তাতে তিনি এমন সংবর্ধনার কথা ভাবতেই পারেন না।
নোবেল কমিটির মতে হান কাংকে পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে তার ‘সুতীব্র কাব্যময় গদ্যের জন্য; যা ইতিহাসের সংকটকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুর দিকটি উন্মোচিত করে।’
কাব্যময় গদ্যের একটা উদাহরণ তার হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাস থেকে নেয়া যেতে পারে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত অসংখ্য মানুষের লাশ আনা হয়েছে এক শরীর-চর্চা কেন্দ্রের চত্বরে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী একজন নারী বললেন, ‘ভাই ও বোনেরা, আমাদের ভালোবাসার ধন শহীদদের দেহগুলিকে রেড ক্রস হাসপাতাল থেকে আজ এখানে আনা হচ্ছে।’ এ কথা বলে তিনি সেই স্কয়ারে জড় হওয়া জনতাকে সাথে নিয়ে একটি সমবেত জাতীয় সংগীত গাইলেন। তার কণ্ঠস্বর অতি দ্রুত শতকণ্ঠে হারিয়ে গেল। একটা কণ্ঠস্বরের ওপর হাজারটা কণ্ঠস্বরের ভিত রচিত হলো। এটা ছিল ধ্বনি সমষ্টির এক সুউচ্চ অট্টালিকা; যা আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। গানের লহরি একেবারে চূড়ায় উঠে পেন্ডুলামের মতো ধীরে ধীরে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। আমাদের অন্য সবার কণ্ঠ সেই কণ্ঠের সমুদ্রে হারিয়ে যায় (অনুবাদ এই প্রবন্ধকারের)।
হান কাংয়ের দেশের সঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনের সংগ্রামী চেতনার প্রভূত মিল থাকায় আমরা তার অমর সৃষ্টির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল হবোÑ এটাই কাম্য।

লেখক: সাবেক যুগ্ম সচিব ও লেখক
৫৮