নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নে কয়েক দফা প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর ফের নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশন থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকার সব বাস চলবে একটি কোম্পানির আওতায় এবং নির্দিষ্ট রুট ধরে চলবে এসব বাস। বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এতদিন এই উদ্যোগের প্রত্যাশিত সফলতা আসেনি। তবে গত ৫ আগস্ট দেশের পটপরিপর্তনের পর নতুন করে আবারও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ঢাকার বাসগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে সর্ব প্রথম ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে প্রথম উদ্যোগ নেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি ঢাকার শতাধিক বাস রুট বাদ দিয়ে কেবল ৫টি রুটে ভাগ করে ৫ রঙের বাস চালানোর পরিকল্পনা হাতে নেন। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে সভাপতি করে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি’ করা হয়। সেই বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৪২টি রুটের ২২টি কোম্পানির অধীনে ৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের বাস চালানোর প্রস্তাব দেয় ডিটিসিএ। কয়েক দফা বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে সভা করার পর ২০২১ সালে তিনটি রুটে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০টি বাস নিয়ে চালু হয় ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। পরে বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০টি করা হয়। কিন্তু ঢাকা নগর পরিবহনের পাশাপাশি একই রুটে অন্য কোম্পানির বাস চলতে থাকা, পরিবহন মালিকদের অসহযোগিতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তেমন সুবিধা করতে পারছিল না উদ্যোগটি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এই প্রকল্প সফল করতে চায় ডিটিসিএ।
গত ১১ নভেম্বর বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২৯তম সভা শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, বাধ্যতামূলকভাবে ঢাকার সব বাস কোম্পানি বিলুপ্ত করে একটি কোম্পানি আওতায় চলতে হবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ১০-১২ জন সদস্য মিলিয়ে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কমিটি বিজনেস মডেল এবং বাসগুলো কীভাবে চলবে সেই বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করবে। আগামী ১১ ডিসেম্বর আবার মিটিং করবো। ঢাকার ৪২টি রুটের কোম্পানিগুলোর বাস নগর পরিবহন নামেই করবো। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন যোগ্যতায় বিবেচনা করে নির্বাচন করা হবে।
ইতোমধ্যে ঢাকায় চলাচল করা বাস কোম্পানিগুলোকে ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় পরিচালনার জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে। এবং পুরো নভেম্বরজুড়ে এই আবেদন গ্রহণ করা হয়। যারা আবেদন করবে না তাদের বাস চলতে দেওয়া হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বমোট ১৭০টি বাস কোম্পানি আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। বর্তমানে এগুলোর মধ্যে থেকে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। পাশাপাশি রুট পুর্নবিন্যাস ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়েও নানা ছক করা হচ্ছে। বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম বলেন, ‘১৭০টি বাস কোম্পানি ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় আসার জন্য আবেদন জানিয়েছে। মোটামুটি ঢাকার ১৭০টি কোম্পানিই রাজধানীজুড়ে বাস পরিচালনা করে। তাই আর কোনও আবেদন প্রত্যাশা করছি না। এই আবেদনগুলোই এখন যাচাই করা হচ্ছে। এর মাঝে যারা শর্ত পূরণ করতে পারবে তারা থাকবে। এছাড়া ঢাকায় বিদ্যমান বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ৩৮৮টি রুটকে সমন্বয় করে ৪০ থেকে ৪৫টি রুটে পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। এই রুটগুলোয় গণপরিবহনের তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কয়েক মাস সময় লাগবে।
এদিকে ঢাকায় শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবহনের সূচনা করতে ডিটিসিএ দৃঢ় সংকল্প জানিয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, ‘গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে রুট পারমিটবিহীন ও রুট ভায়োলেশনকারী বাসগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে চালক ও সহায়কদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া ডিটিসিএর প্রস্তুত করা প্রস্তাবনার সমন্বয়ে অচল রুট বাতিল ও নতুন রুটগুলোর পরিকল্পনা প্রয়োজনবোধে পরিমার্জন করা হবে। ইতোমধ্যে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির মাধ্যমে ১১০টিরও বেশি বাস স্টপ তৈরি করা হয়েছে।’
ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন বাস মালিকরা। এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক মো. সাইফুল আলম বলেন, ‘গত ১৫ বছর সড়ক পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশে মালিক সমিতি, বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি, বাস টার্মিনাল এবং শ্রমিক ইউনিয়ন দখল করে চাঁদাবাজি করেছে আওয়ামী লীগের লোকজন। তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে, দলীয় কর্মকাণ্ডে মালিক-শ্রমিকদেরও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করে। এই ধারা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই। আমরা চাই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। নাগরবাসীর যেন স্বস্তিতে চলাচল করতে পারে এবং শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি পায়, এজন্য আমরা সব ধরনের সহয়তা করতে রাজি।’
ঢাকা নগর পরিবহন কেমন হবে: সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, ঢাকা নগর পরিবহন নামে শহরের গণপরিবহন পরিচিত হবে। শহরের বাইরের সঙ্গে সংযোগকারী পরিবহনের নাম হবে শহরতলী পরিবহন। ৩৪টি রুট নগরের ও ৮টি রুট শহরতলীর। কোম্পানির নামে বাস রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, ব্যক্তি নামে আর কোনও বাসের রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিট দেওয়া হবে না। কাউন্টার ও টিকিট ব্যতীত কোনও বাস চলবে না। টিকিটের সঙ্গে পরবর্তীতে র্যাপিড পাস ব্যবহারের সুযোগ রাখা হবে। নতুন করে বাস মেরামত করা হবে। বাসগুলোতে ধাপে ধাপে স্বয়ংক্রিয় দরজা লাগানো হবে, আসন বিন্যাস করা হবে এবং সিঁড়ির ধাপ বাড়বে। এছাড়াও ক্যামেরা বসবে, ড্যাশক্যাম থাকবে। স্টপেজেও ক্যামেরা রাখা হবে। ড্রাইভার ও হেলফার নিয়োগ হবে কোম্পানি থেকে, তারা কোনও ভাড়া আদায় করবে না।