নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, “আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। আমার ৩৬ বছরের সিভিল ও পাবলিক সার্ভিসে আমি কখনোই এমন অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি। ” তিনি বলেন, আমার কর্মজীবনে দুই ধরনের ঘাটতি দেখেছি; তা হচ্ছে- চলতি হিসাবের ঘাটতি ও রাজস্ব ঘাটতি। একই সাথে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি হতে কখনোই দেখিনি। তবে তিনি মনে করেন পরিস্থিতি একেবারে তলানীতে নেমে এসেছে। আর খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। এখন অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। জাতীয় নির্বাচনের পর অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি। সোমবার (৬ নভেম্বর) অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জ এবং এগুলোর মোকাবেলায় গৃহীত নানা ব্যবস্থা ও অগ্রগতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন। উল্লেখ, প্রথমে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর আঘাত। ওই ধাক্কা সামলে উঠার আগেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে টালমাটাল হয়ে উঠে বিশ্ব অর্থনীতি। এর তীব্র প্রভাব পড়ে আমাদের অর্থনীতিতেও। বিপুল অর্থ পাচার, রপ্তানি আয়ের সংকোচন, লাগামহীন হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সে নি¤œমুখী ধারা, বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ ইত্যাদি কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের পতন হয়েছে। পতন ঠেকাতে পণ্য আমদানির এলসিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য ব্যাপক বেড়ে গেছে। ডলারের একরকম হাহাকার চলছে। খোলা যাচ্ছে না পণ্য আমদানির এলসি। বিপুল জনশক্তি রপ্তানির পরও সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে নেমে এসেছে। অক্টোবরে ব্যাপকভাবে কমেছে রপ্তানি আয়। অন্যদিকে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬, যা গত প্রায় ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতে বল্গাহীনভাবে বাড়ছে খেলাপী ঋণের পরিমাণ। এই বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা ও সামগ্রিক অর্থনীতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সাথে ধারাবাহিক সভা করছেন গভর্নর। এরই অংশ হিসেবে ইআরএফের সাথে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী যে স্থিতিশীলতা আসবে তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। তাতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়বে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস থেকেও বাড়তি অর্থায়ন সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। আর নিচে নামার সুযোগ নেই। এখন ওপরের দিকে উঠতে হবে। ফলে আগামী ডিসেম্বরেই মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করবে। ডিসেম্বরে এ হার কমে ৮ শতাংশে নামতে পারে। চলতি অর্থবছরের শেষদিকে তা ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর থেকে এ চাপও কমে আসবে। দেশ থেকে টাকা পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হুন্ডির চেয়ে ব্যবসার আড়ালে ১০ গুণ বেশি অর্থ পাচার হয়। পাচারের অর্থে দুবাইতে ১৩ হাজার বাংলাদেশি কোম্পানি গঠন করেছেন। আর পর্তুগালে আড়াই হাজার কোম্পানি গঠন করেছেন বাংলাদেশিরা। এসব কোম্পানি গঠন করা হয়েছে পাচার করা অর্থে। দেশ থেকে আগে প্রতিমাসে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হতো। কঠোর তদারকির ফলে এখন তা কমে এসেছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে নতুন করে আর কোনো ঋণ দেওয়া হবে না। নতুন কোনো তহবিলও গঠন করা হবে না। আগে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে বা তহবিল গঠন করা হয়েছে সেগুলো থেকে আদায়ের মাধ্যমে ঋণের স্থিতি বা তহবিলের আকার ছোট করে আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে আগে যে অস্থিরতা ছিল, তা অনেকটা কমে গেছে। আগামীতে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিতি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সলিমুল্লা, ডেপুটি গভর্নর, অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ইআরএফের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমসহ অন্য নেতারা।
সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্বীকার করেন, পণ্যমূল্য বাড়ানোর নেপথ্যে সিন্ডিকেট হচ্ছে। সেজন্য অযৌক্তিকভাবে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও সেগুলোর দামও বাড়ছে। সেজন্য মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এর মাধ্যমে ডলারের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
চাকরী জীবনে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখিনিঃ গভর্নর
চাকরী জীবনে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখিনিঃ গভর্নর
জনপ্রিয় সংবাদ