মোস্তফা হোসেইন : যুদ্ধাপরাধী ও চরম সাম্প্রদায়িক দল জামায়াতে ইসলামি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের জাতীয় দাবি পূরণ হবে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে। একইসঙ্গে কিছু আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। লাখ লাখ কর্মী ওদের। অধিকাংশ ইউনিয়নেও তাদের সংগঠন বিস্তৃত। আছে জীবনভর সংঘাত ও নৃশংসতা সৃষ্টির অভিজ্ঞতা। এই ক্যানসার জীবাণু সমাজে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, সে বিষয়ে কী করণীয়?
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের পরও কিছু মানুষ এখনও সন্দেহের দোলায় দুলছে। সন্দেহবাদী মানুষরা এতদিন বলতো– যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামিকে কি শেখ হাসিনা বিচার করবে? এই সন্দেহবাদীদের বক্তব্য ছিল-জামায়াতিদের ঝুলিয়ে রেখে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করবে আওয়ামী লীগ সরকার।
বাস্তবতা হলো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। যেখানে দণ্ডভোগকারীদের মধ্যে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদেরই প্রাধান্য। মহামান্য আদালত যখন জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন বাতিলের নির্দেশ দিলেন, রাজনীতিতে সেই কথা আবার ঘুরে ফিরে এলো। বলা হতে থাকে জামায়াতে ইসলামিকে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করবে আওয়ামী লীগ। জামায়াত ঠিকই রাজনীতিতে থাকবে, রাজনীতি করবে। বড় দুই দলই তাদের ব্যবহার করবে। সমালোচকদের একটি অংশ আবার জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় সরকারের সমালোচনাও করেছে। বিশেষ করে টকশোগুলোতে বলা হতে থাকে– জামায়াতকে কথা বলতে দেবেন না কেন? তারা যদি যুদ্ধাপরাধীই হয়ে থাকে তাহলে তাদের নিষিদ্ধ করছেন না কেন?
টকশোতে বিএনপি দলীয় বক্তারা সবসময়ই বলতেন, সেটা করলে যে সরকারের রাজনীতি থাকবে না। সর্বশেষ সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে আশা করা যায় তাদের সেই প্রশ্নের জবাবও পাওয়া যাবে।
গত ২৯ জুলাই (সোমবার) গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলীয় জোটের সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে জামায়াত নিষিদ্ধের কথা বলা হয়। তারপরও আমার এক ফেসবুক বন্ধু বললেন, আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে না। এটা আইওয়াশ মাত্র। বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার কৌশল মাত্র। এদিকে মঙ্গলবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আগের রাতে তাদের সিদ্ধান্তের কথা আবারও বললেন।
প্রশ্ন আসতে পারে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে? বহুল আলোচিত প্রভাবগুলোর মধ্যে বলা যেতে পারে– তাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া; বিএনপিও ওদের সমমনা অন্য দলে নিজেদের বিলীন করে দেওয়া ও ভিন্ন নামে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ।
জামায়াতে ইসলামি আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলে কী প্রতিক্রিয়া হবে এর রিহার্সাল ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলটি প্রকাশ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তাদের কর্মকাণ্ড মূলত আন্ডারগ্রাউন্ডেই পরিচালিত হয়েছে। অঘোষিত আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালে তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, তাই বলে তাদের হিংস্র থাবা থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে কিংবা পাবে এমনটা বলার কোনও কারণ নেই। অন্যদিকে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে না পারলেও তাদের সাংগঠনিক কাজ বন্ধ ছিল না। তারা নিজেদের মতো করে সংগঠিত হয়েছে, একইভাবে বিকল্প পথও ঠিক করে নিয়েছে। সুযোগ পেলেই তাদের হিংস্রতা প্রকাশ করবে তা সাম্প্রতিক হিংস্রতা থেকে প্রমাণ হয়ে গেছে। আরও বলা দরকার, তারা এই হিংস্রতাকে তাদের নিত্য কর্মসূচি হিসেবেই দেখে থাকে। এ ধরনের হিংস্রতাকে তারা জিহাদের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। আর সেটা সবাই জানে তাদের কর্মী বাহিনী ওভাবেই তৈরি করা হয়। তাদের মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হয় জিহাদে জয়ী হলে গাজী এবং মরলে শহীদ। তাদের জন্য বেহেস্ত নিশ্চিত। এমন শহীদ হওয়ার প্রলোভন ছাড়তে চায় কে?
তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনকালে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হয়। কীভাবে অহিংস ছাত্র আন্দোলনটি সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয়ে দুই শতাধিক প্রাণহানি ঘটলো, হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেলো গোপন সংগঠনের মতো কার্যকর এই জামায়াতে ইসলামির সংস্পর্শে এসে। এমতাবস্থায় সরকারকে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে। ১৪ দলীয় জোটের দীর্ঘদিনের প্রস্তাবেরও সুরাহা হতে যাচ্ছে এর মাধ্যমে। জামায়াতে ইসলামির সমর্থক কিংবা কর্মীদের কেউ কেউ ইতোপূর্বে কিছু দলে যোগদান করেছে। অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগেও তাদের অনেককে ফুলের তোড়াসহ গ্রহণ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর হয়তো তাদের গ্রহণের একটি প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের নেতাকর্মীদের তালিকা প্রকাশ করলেও কতটা কার্যকর হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ভিন্ননামে সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আগেই দেখা গেছে। এবি পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াত ত্যাগীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। তাদের রাজনৈতিক আদর্শও জামায়াতের মতোই। প্রকাশ্যে তারা মুক্তিযুদ্ধের কথাও বলছে। এখন এই দলটি যদি জামায়াত কর্মীদের ছাতা হয়ে দাঁড়ায় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বলা হয়ে থাকে এবি পার্টির জন্ম হয়েছে জামায়াতেরই এজেন্ডা নিয়ে। সেখানে জামায়াতের প্রথম কাতারের নেতাদের কেউ থাকবে না। আর নতুন নামে সংগঠন তৈরি হলেও তারা সেই কাজটি করবেও না।
সেক্ষেত্রে সরকারকে শুধু নিষিদ্ধ করে থেমে থাকলে ফল হবে ভিন্নরকম। উপজেলাভিত্তিক তালিকা করে তা প্রকাশ করাটা জরুরি। তাদের শুধু রাজনৈতিক অধিকারই নয়, সামাজিক সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় সংগঠন করারও অধিকার রহিত করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি যেহেতু ধর্মপালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, তারা সেই অধিকার ভোগের নিশ্চয়তাও পাবে। ভারতে জামায়াতে ইসলামি নিষিদ্ধ করার পর সেখানে তাদের কিছু নেতা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নামে। আর জামায়াতে ইসলামির সৃষ্টিও ছিল অরাজনৈতিক নাম দিয়ে। যেমন বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম এখন অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নামে রাজনীতি করার প্রয়াস পাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামি হিন্দও সেভাবেই গড়ে উঠেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও যেভাবে জামায়াতের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে উঠেছে সেই প্রবণতা কি বন্ধ হবে? বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কথা। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে উল্লেখ আছে– ‘১২. ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য- ক. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, ঘ. কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’
এই বিধান ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংহত করার জন্য প্রণীত হয়েছে। এখন কেউ যদি মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গ আনেন, তাহলে তাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের দিকে নজর দিতে হবে। সেখানে প্রত্যেক নাগরিককে সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে কিছু শর্তও আরোপ করা হয়েছে। সংবিধানে উল্লেখ আছে-
সংগঠনের স্বাধীনতা: ‘৩৮। জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবেঃ তবে শর্ত থাকে যে, কোন ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি-(ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।’
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামি যদি ধর্মীয় সংগঠনের নামে কোনও সংগঠন মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করে তাও হবে সংবিধান পরিপন্থি।
সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। তাদের না হয় যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের শাস্তি হিসেবে এর স্থায়িত্ব কতটুকু। দল কিংবা সংগঠন নিষিদ্ধ করতে গিয়ে শুধু সরকারি নির্দেশই যথেষ্ট। কিন্তু এর স্থায়িত্ব কতটুকু। সামান্য রাজনৈতিক স্বার্থে ভবিষ্যতে যে তাদের আবার স্বরূপে প্রকাশ হবে না তার নিশ্চয়তা কী?
জামায়াত নিষিদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্ন এসে যায়-সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে আত্মস্বীকৃত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার পায়। শুধু রাজনীতি করাই নয়, তারা নির্বাচন করার অধিকারও পেয়েছে নির্বাচন কমিশন থেকে। ইসলামি শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন নাম নিয়ে রাজনীতি করছিল চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলটি। নির্বাচন কমিশনের আপত্তির কারণে তারা ইসলামি আন্দোলন নামে নিবন্ধন পায়। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা তাদের দলীয় লক্ষ্য হিসেবে কি ইসলামি শাসনতন্ত্রকে বাদ দিয়েছে? তারা স্পষ্টত বলছে তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করবে। তাদের এই ঘোষণা কি সংবিধানের পরিপন্থি নয়? খেলাফত মজলিশসহ আরও কিছু সংগঠনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন দাবি করছে, তারা অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড সবসময়ই রাজনীতি কেন্দ্রিক। তাদেরও লক্ষ্য ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সংবিধান পর্যালোচনায় এমন অসংখ্য সংগঠনের বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়বেই। অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হেফাজতে ইসলাম কীভাবে সরকার হটানোর মতো রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামতে পারে তা বোধকরি শাপলা চত্বরের সমাবেশের পর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। সুতরাং শুধু জামায়াতের সাইনবোর্ড নিষিদ্ধ করাই নয়, জামায়াতের ব্যক্তিগুলোও যাতে কোনও সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করতে না পারে সেই বিষয়টিও নজর দিতে হবে। একইসঙ্গে সংবিধান পরিপন্থি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যেসব সংগঠন আছে, হোক সেটা ধর্মীয় আবরণে কিংবা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের মুখোশ পরা-তাদের নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া অতি জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।