নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে সকাল-সন্ধ্যা সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে সড়ক ও রেলপথ অবরোধে স্থবির হয়ে পড়েছে সব ধরনের যান চলাচল। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী।
এদিকে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আজ বৃহস্পতিবারও বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে তারা এ কর্মসূচি পালন করবেন।
গতকাল বুধবার সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন শেষে রাজধানীর শাহবাগ চত্বর থেকে বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এর আগে বিকাল ৪টার পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ পালন শেষে শাহবাগে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সেখানে আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মূল একটি অংশ অবস্থানে ছিলেন। বুধবার সন্ধ্যা ৭টার পর শাহবাগ থেকে বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ। বাংলা ব্লকেডে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেলপথ এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত থাকবে বলে আগের দিনই জানিয়েছিলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ফলে বুধবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে অনেক জায়গায় ঢাকার সঙ্গে আঞ্চলিক এবং অনেক এলাকায় অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়।
এদিন রাজধানীর শাহবাগ, গুলিস্তান, চানখাঁরপুল, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, কারওয়ান বাজার, রামপুরা, মিন্টো রোড, ফার্মগেট, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। টানা বাংলা ব্লকেডে থেমে গেছে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ। অফিস ফেরত যাত্রী, ঢাকা থেকে মফস্বলগামী যাত্রী, শিক্ষার্থী ও অসুস্থ রোগীরা এতে বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্করা ভোগান্তিতে পড়েছেন বেশি। সামর্থ্যবান অন্যরা বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করলেও নারী-শিশু ও বয়স্করা পথেই বসে পড়েন ক্লান্ত হয়ে।
সকালে ঢাবি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তারা এখান থেকে শাহবাগ পয়েন্টে অবস্থান নেন। সেখানে তারা পুরো শাহবাগ পয়েন্ট অবরুদ্ধ করেন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি পয়েন্ট সায়েন্সল্যাব মোড়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছেন বলে জানান সেখানে থাকা ঢাকা টাইমস প্রতিবেদক মো. মুজাহিদুল ইসলাম নাঈম। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরাও মিছিল সহকারে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে এসে অবস্থান নেন। এছাড়াও ঢাবি অধিভুক্ত আরও কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীদেরও সেখানে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে রাজধানীর অত্যন্ত ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজারের সড়ক অন্য দিনের তুলনায় অনেকটাই ফাঁকা বলে জানা যায়। এদিন কারওয়ান বাজারে রেল ক্রসিংয়ে কাঠের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। ফলে সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি রাজধানীর রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিনের তুলনায় কারওয়ান বাজার এলাকায় যানবাহনের চাপ একেবারেই কম ছিল। ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকতে হচ্ছে না বিধায় পয়েন্টও দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। এর আগে সকাল সাড়ে দশটার দিকে আগারগাঁওয়েও একই রকম চিত্র দেখেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের পথে গুরুত্বপূর্ণ আরিচা মহাসড়ক সকাল ১০টা থেকে অবরোধ করে রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখানে থাকা ঢাকা টাইমস প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম জানান, শিক্ষার্থীদের অবরোধের ফলে এই মহাসড়কে অচলাবস্থা তৈরি হয়। এদিকে দ্বিতীয় দিনের মতো রাজধানীর গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট অংশ অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। এসময় জবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সরকারি কবি নজরুল কলেজ ও সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। বুধবার বিকাল ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা রাজধানীর এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা অবরোধ করেন। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অবরোধ চলমান রয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাতায়াতকারী যাত্রীরা। চট্টগ্রামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রতাশীরা। ঢাকা টাইমসের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান জানান, চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানহাটে রেলপথ ও সড়কপথ অবরোধ করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামের সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন। তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল করে বিক্ষোভ করেছেন।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এর ফলে ওই সড়কে যান চলাচল অনেকটাই বন্ধ হয়ে পড়েছে। চতুর্থ দিনের মতো বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি অংশ অবরোধ করেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা। ফলে সড়কে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাতায়াতকারী যাত্রীরা। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বুধবার সকাল ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি অবরোধ করেন।
সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা আবারো ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করেছেন। এদিকে সকাল ১০টা থেকে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে জড়ো হয়ে সড়কটি অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা জানান, সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে অবরোধ কর্মসূচি। বুধবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দেওয়ানগঞ্জগামী ‘তিস্তা এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি অবরোধ করেন বাকৃবির শিক্ষার্থীরা। এতে করে চতুর্থবারের মতো ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করলেন তারা। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ট্রেনটিতে থাকা শত শত যাত্রী। সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধিতা করে গত ৭ ও ৮ জুলাইও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। শিক্ষার্থীদের এমন কর্মসূচিতে ওই দুদিন দুপুরের পর রাজধানী ঢাকার সড়ক কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। অশেষ ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। তবে মঙ্গলবার এ ধরনের কর্মসূচির পরিবর্তে অনলাইন-অফলাইনে গণসংযোগ করেন তারা। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় বুধবার সকাল-সন্ধ্যা সারাদেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এমন কর্মসূচিতে মানুষের ভোগান্তি হওয়ার কথা স্বীকার করেন এ প্লাটফর্মের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘৫ জুন থেকে আমরা আন্দোলনে আছি। হাইকোর্টের রায়ের কারণে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। আমরা চাই না সাধারণ মানুষের কোনো ভোগান্তি তৈরি হোক। কিন্তু এখনো নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি বা আশ্বাস পাইনি। সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে কোটা বৈষম্য নিরসনের কথা বলছি আমরা।’
ঢাকার সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ: কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সড়কের পাশাপাশি রেলপথ অবরোধ করায় ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে। রেলওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, আন্দোলনকারীরা মহাখালী রেলগেট ও কারওয়ান বাজারে তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় রেললাইনে অবস্থান নিলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মহাখালী রেল গেট এলাকায় অবস্থান করা ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস বলেন, “ওরা (আন্দোলনকারীরা) এখানে সাড়ে ১১টার দিকে বসেছে। প্রায় তখন থেকেই ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।” এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় ম্যানেজার শফিকুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল ধরেননি। তবে রেলের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু হয়ে রেল যোগাযোগ চালু রয়েছে। দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা এই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে এবং ময়মনসিংহেও রেলপথ অবরোধের খবর পাওয়া গেছে।
বুধবার সকাল ১১টা থেকে দেওয়ানহাট ব্রিজের নিচে রেললাইনে অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাদের অবস্থানের কারণে ঢাকা থেকে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস বেলা ১১:৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়নি বলে জানিয়েছেন পূর্ব রেলের বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সাইফুল ইসলাম।
এছাড়াও বেলা ১২টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন ‘মহানগর এক্সপ্রেস’ ও বেলা তিনটার ‘গৌধুলী এক্সপ্রেস’ও ছাড়েনি। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ‘মহানগর এক্সপ্রেস’ চট্টগ্রাম স্টেশনে প্রবেশ করতে না পেরে ফৌজদারহাট স্টেশনে অবস্থান করছিল। ময়ম্নসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড়-সংলগ্ন এলাকায় ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ‘তিস্তা এক্সপ্রেস’ ট্রেন আটকে দেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। বাকি ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এবং এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের।