ঢাকা ১০:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

কাজ দেখে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানাতে চাই

  • আপডেট সময় : ০১:৪৯:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৪
  • ৩১ বার পড়া হয়েছে

মুনজের আহমদ চৌধুরী  :  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে নবেল লরিয়েটদের রাজনীতিতে নামতে উৎসাহিত করে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও নোবেল পুরস্কার লাভ করার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠন করার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। তারপরও গত ষোল বছর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রকাশ্যে রাজনীতি করার কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কিন্তু রাজনীতিতে আসতে চাওয়ার অপরাধে শেখ হাসিনার সরকার তাকে ক্রমাগত গ্রামীণ ব্যাংকের কর ফাঁকি, দুর্নীতির মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এ মুহূর্তে ড. ইউনূসের মতো বিশ্বে গ্রহণযোগ্য কেউ ছিলেন না। ড. ইউনূসের বয়স এখন ৮৪ বছর। বাংলাদেশে তিনিই সেই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে গত বিশ বছরের বেশি সময় ধরে একটি নির্দলীয় সরকারের প্রধান হওয়ার মতো যোগ্য মনে করা হচ্ছিল।
শেখ হাসিনা গত ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে ড. ইউনূসকে বিএনপি-জামায়াতের পর দ্বিতীয় প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সুদখোর, দুর্নীতিবাজ বলে সীমাহীন মন্তব্য করেছেন। ৮৪ বছর বয়সের একজন সফল ব্যক্তিকে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়েছেন। পরিকল্পিতভাবে জেলে ঢুকানোর চেষ্টা করেছেন। তবে ড. ইউনূস দেশ বা মাঠ ছেড়ে যাননি। শক্ত মনোবল নিয়ে অব্যাহত সরকারি বাধার মুখেও তিনি তার মতো কাজ করে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন বাংলাদেশ প্রশ্নে ড. ইউনূস ধরে রেখেছেন। ড. ইউনূসের চেয়ে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত মানুষ আর কেউ দেশে নেই। ড. ইউনূস সেই ব্যক্তি যার মাইক্রো ক্রেডিটের ফর্মুলা দেশে দেশে পড়ানো হয়। তার সৃষ্ট সফল ফর্মুলার চর্চা হয় সারা বিশ্বে। তিনি বিশ্বকে শিখিয়েছেন বিনা জামানতে লোন পাওয়া গরিব মানুষের অধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানসহ যেসব দেশে মার্কিন সমর্থন নিয়ে পট পরিবর্তন হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম দৃষ্টিকটু উপায়ে হলো বাংলাদেশে। আমার ধারণা নতুন প্রধান উপদেষ্টা কেবল কিছু দিনের জন্য দায়িত্ব নিয়ে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার জন্য অতীতে এত কিছু সহ্য করেননি। আর এ বয়সে দেশের ক্রান্তিকালে দায়িত্বও নেননি। তার সুযোগ, সেই সক্ষমতা আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার। দায়িত্ব নেওয়ার পরের বক্তব্যে মনে হয়েছে তিনি আত্মবিশ্বাসী।
প্রত্যাশা করি, গত ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো এ সরকার থেকেও কয়েক মাস পর কয়েকজন উপদেষ্টাকে যেন পদত্যাগ না করতে হয়। দেশের অর্থনীতি ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত। দেশের রাজনীতিতে নৈতিকতার মান ক্রমশ নিম্নগামী। সুস্থ নির্বাচনের সংস্কৃতি অতীত হয়ে গেছে। পেশাজীবীরা বিভক্ত নগ্ন দলীয়করণ ও সুবিধাবাজিতে। ভয়াল এক পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি বাংলাদেশের জন্য কি করতে পারেন সেটা প্রমাণ করার জন্য তার হাতে বেশি সময় নেই। উপদেষ্টারা কে কী করছেন সেটাও বিবেচ্য থাকবে না। বিষয়টি হলো, এই সরকারের প্রধান এখন ড. ইউনূস। এটা তার মতো সারা বিশ্বে সম্মানিত মানুষের সরকার। আমরা প্রকাশ্যে দেখছি, সেনাবাহিনী শুরু থেকে ড. ইউনূসকে সমর্থন করছে। সমর্থন করছেন সাধারণ মানুষও। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি,পরিবারতন্ত্র, বিদেশে টাকা পাচারে দেশের মানুষ হতাশ। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অপরিহার্য। দরকার অর্থবহ ইতিবাচক সমন্বিত পরিবর্তনের প্রয়াস। তার হাত ধরে নষ্ট সিস্টেমের পরিবর্তনের অন্তত শুরুটা হোক, এটাই মানুষের প্রত্যাশা। আমার বিশ্বাস, যার পরিচয় দুনিয়াজোড়া তিনি দেশের জন্য, নিজের নামের প্রতি সুবিচারের জন্য কিছু করে যাবেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রথম সাক্ষাৎকারে যেসব কথা ভারতকে উদ্দেশ করে বলেছেন, সেই কথাগুলো জোরালোভাবে বলার লোক এখন দেশে কোনও দলে তেমন নেই। নতুন সরকারকে ভারতসহ পুরো বিশ্ব তাৎক্ষণিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে।
উপদেষ্টাদের মধ্যে ৯ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ৩ জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১ জন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের। আমি জানি না সাংবাদিক নুরুল কবীর, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক আলী রিয়াজ স্যারকে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিনা। আলী রিয়াজ স্যাররা হয়তো আসতেন না। কিন্তু আনু মোহাম্মদ বা তার প্রজন্মের একজন সরাসরি শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারতো। কারণ তারা বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবী। কম বিতর্কিত, অপেক্ষাকৃত যোগ্য অনেক মানুষ ছিলেন উপদেষ্টা পদে ঠাঁই পাওয়ার মতো। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বস্ততাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
নতুন সরকার আমলে এলজিবিটি কমিউনিটি আরও বেশি সুবিধা পাবে। কেননা, উপদেষ্টাদের মধ্যে এনজিও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। সুশীল সমাজের একটি অংশ বিগত ওয়ান ইলেভেনের শুরুতে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভোল পাল্টে মিডিয়ার একটি অংশও বলেছিল এটি তাদের সরকার। এ সরকারেও তারা দেনদরবার করে নিজেদের সংহত করার, ক্ষমতার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছে।
প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা যারা হয়েছেন তারা নৈতিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকার কারণে সামনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বা কাউকে সমর্থন দেওয়ার পথে না হেঁটে দেশের জন্য কিছু ভালো কাজ করে যাবেন, এটাই মানুষের প্রত্যাশা। ছাত্র প্রতিনিধি দুজনকে এ কারণে অভিনন্দন। আমরা মুখে সবসময় বলি নতুন, তরুণ নেতৃত্ব চাই। অথচ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি শেষ করা এ দুই তরুণকে নেতৃত্বের কাতারে দেখতে সহ্য না হওয়া আমাদের ঈর্ষাগত জাতীয় সমস্যা। তরুণ দুজনের উচিত তাদের কাজ দিয়ে ছাত্রসমাজের সম্মান ধরে রাখা। ভোগে ব্যস্ত না হয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করা। অগ্রাধিকার তালিকায় কারামুক্তির জন্য বিএনপির অপু, মামুন, বাবরদের জন্য অনুরোধ নাকি গেছে খোদ তারেক রহমানের পক্ষ থেকে।
নতুন সরকার গঠনের আগে দেশে বহু খারাপ কাজ হয়েছে গত কয়েক দিনে। লুটপাট, ডাকাতি, চাঁদাবাজির পাশাপাশি দেশের শীর্ষ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া রাতারাতি ভোল পাল্টেছে। দ্রুতলয়ে খোলস পাল্টাচ্ছে আমাদের বর্ণচোরা সুবিধাকামী সমাজ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভালো কিছু করে দেখানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অবশ্যই আমাদের সময় দেওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টা ২৭টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখেছেন। দ্রুত নতুন কয়েকজনকে প্রয়োজনে যুক্ত করার সুযোগ রেখেছেন। কাজ করার সুযোগ নিজের হাতে রেখেছেন।
শেখ হাসিনা প্রশাসন পাঠ্যপুস্তক, ইতিহাসে সব কিছু গত ষোল বছরে ইচ্ছে খুশিমতো সাজিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাকেও চলে যেতে হয়েছে। উন্নয়নের গল্পের চেয়ে গুণগত রাজনীতি মানুষের প্রত্যাশা সেটি প্রমাণিত হয়েছে। রাজনীতি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই রাজনীতিতে যতক্ষণ সমাজের অপেক্ষাকৃত ভালো মানুষগুলো সামনে না আসতে পারবেন, ততক্ষণ ভালো কিছু সম্ভব নয়। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমার পেশা হলো জনমনে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তরের খোঁজ করা। বিভিন্ন সরকার আমলে জার্সি বদল করা সুবিধাবাজ, দালাল, ক্ষমতার পদলেহন করা কিছু ভৃত্য আছে। তারা ছাড়া পেশাদার সাংবাদিকের কোনো দল নেই। নৈতিক সাংবাদিকের কোনোকালে কোনও রাজনৈতিক ট্যাগ থাকে না, থাকতে নেই।
ক্ষমতার বদল হলেও নৈতিক, পেশাদার সাংবাদিকের জন্য পরিস্থিতি বদলে যাবে, সেই উচ্চ আশা কখনও করি না। চলতি বাস্তবতায় পাপ, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল,পাল্লার মতো মার্কা ও ছদ্মবেশী সুশীলের গন্তব্য কেবলই ক্ষমতা। ক্ষমতা কামড়ে থাকা অথবা ক্ষমতায় পৌঁছার লড়াই। এই আন্দোলন চলাকালেও সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, শিল্পীদের নির্লজ্জ দালালি সাধারণ মানুষদের হতবাক করেছে। বরং বহুবার ক্ষমতার মার্কা বা চেহারা বদল হলেও নৈতিক আদর্শ না বদলানো, পথ দেখানো মানুষের মুখগুলোর সারি যেন দীর্ঘ হয়, সেই দিন দেখার প্রত্যাশায় থাকি। আমরা শুধু ক্ষমতার মুখগুলোর পরিবর্তন চাই না। অর্থবহ ইতিবাচক পরিবর্তনের ভিত্তিপ্রস্তর হোক। দেশের শাসক, রাজনীতিবিদরা ভালো হলে, দুর্নীতি কমাতে পারলে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া হতে মাত্র ৫ বছর লাগবে।
লেখক: যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সাংবাদিক

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

গুমের তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি কমিশনের

কাজ দেখে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানাতে চাই

আপডেট সময় : ০১:৪৯:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৪

মুনজের আহমদ চৌধুরী  :  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে নবেল লরিয়েটদের রাজনীতিতে নামতে উৎসাহিত করে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও নোবেল পুরস্কার লাভ করার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠন করার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। তারপরও গত ষোল বছর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রকাশ্যে রাজনীতি করার কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কিন্তু রাজনীতিতে আসতে চাওয়ার অপরাধে শেখ হাসিনার সরকার তাকে ক্রমাগত গ্রামীণ ব্যাংকের কর ফাঁকি, দুর্নীতির মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এ মুহূর্তে ড. ইউনূসের মতো বিশ্বে গ্রহণযোগ্য কেউ ছিলেন না। ড. ইউনূসের বয়স এখন ৮৪ বছর। বাংলাদেশে তিনিই সেই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে গত বিশ বছরের বেশি সময় ধরে একটি নির্দলীয় সরকারের প্রধান হওয়ার মতো যোগ্য মনে করা হচ্ছিল।
শেখ হাসিনা গত ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে ড. ইউনূসকে বিএনপি-জামায়াতের পর দ্বিতীয় প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সুদখোর, দুর্নীতিবাজ বলে সীমাহীন মন্তব্য করেছেন। ৮৪ বছর বয়সের একজন সফল ব্যক্তিকে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়েছেন। পরিকল্পিতভাবে জেলে ঢুকানোর চেষ্টা করেছেন। তবে ড. ইউনূস দেশ বা মাঠ ছেড়ে যাননি। শক্ত মনোবল নিয়ে অব্যাহত সরকারি বাধার মুখেও তিনি তার মতো কাজ করে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন বাংলাদেশ প্রশ্নে ড. ইউনূস ধরে রেখেছেন। ড. ইউনূসের চেয়ে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত মানুষ আর কেউ দেশে নেই। ড. ইউনূস সেই ব্যক্তি যার মাইক্রো ক্রেডিটের ফর্মুলা দেশে দেশে পড়ানো হয়। তার সৃষ্ট সফল ফর্মুলার চর্চা হয় সারা বিশ্বে। তিনি বিশ্বকে শিখিয়েছেন বিনা জামানতে লোন পাওয়া গরিব মানুষের অধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানসহ যেসব দেশে মার্কিন সমর্থন নিয়ে পট পরিবর্তন হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম দৃষ্টিকটু উপায়ে হলো বাংলাদেশে। আমার ধারণা নতুন প্রধান উপদেষ্টা কেবল কিছু দিনের জন্য দায়িত্ব নিয়ে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার জন্য অতীতে এত কিছু সহ্য করেননি। আর এ বয়সে দেশের ক্রান্তিকালে দায়িত্বও নেননি। তার সুযোগ, সেই সক্ষমতা আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার। দায়িত্ব নেওয়ার পরের বক্তব্যে মনে হয়েছে তিনি আত্মবিশ্বাসী।
প্রত্যাশা করি, গত ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো এ সরকার থেকেও কয়েক মাস পর কয়েকজন উপদেষ্টাকে যেন পদত্যাগ না করতে হয়। দেশের অর্থনীতি ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত। দেশের রাজনীতিতে নৈতিকতার মান ক্রমশ নিম্নগামী। সুস্থ নির্বাচনের সংস্কৃতি অতীত হয়ে গেছে। পেশাজীবীরা বিভক্ত নগ্ন দলীয়করণ ও সুবিধাবাজিতে। ভয়াল এক পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি বাংলাদেশের জন্য কি করতে পারেন সেটা প্রমাণ করার জন্য তার হাতে বেশি সময় নেই। উপদেষ্টারা কে কী করছেন সেটাও বিবেচ্য থাকবে না। বিষয়টি হলো, এই সরকারের প্রধান এখন ড. ইউনূস। এটা তার মতো সারা বিশ্বে সম্মানিত মানুষের সরকার। আমরা প্রকাশ্যে দেখছি, সেনাবাহিনী শুরু থেকে ড. ইউনূসকে সমর্থন করছে। সমর্থন করছেন সাধারণ মানুষও। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি,পরিবারতন্ত্র, বিদেশে টাকা পাচারে দেশের মানুষ হতাশ। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অপরিহার্য। দরকার অর্থবহ ইতিবাচক সমন্বিত পরিবর্তনের প্রয়াস। তার হাত ধরে নষ্ট সিস্টেমের পরিবর্তনের অন্তত শুরুটা হোক, এটাই মানুষের প্রত্যাশা। আমার বিশ্বাস, যার পরিচয় দুনিয়াজোড়া তিনি দেশের জন্য, নিজের নামের প্রতি সুবিচারের জন্য কিছু করে যাবেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রথম সাক্ষাৎকারে যেসব কথা ভারতকে উদ্দেশ করে বলেছেন, সেই কথাগুলো জোরালোভাবে বলার লোক এখন দেশে কোনও দলে তেমন নেই। নতুন সরকারকে ভারতসহ পুরো বিশ্ব তাৎক্ষণিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে।
উপদেষ্টাদের মধ্যে ৯ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ৩ জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১ জন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের। আমি জানি না সাংবাদিক নুরুল কবীর, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক আলী রিয়াজ স্যারকে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিনা। আলী রিয়াজ স্যাররা হয়তো আসতেন না। কিন্তু আনু মোহাম্মদ বা তার প্রজন্মের একজন সরাসরি শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারতো। কারণ তারা বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবী। কম বিতর্কিত, অপেক্ষাকৃত যোগ্য অনেক মানুষ ছিলেন উপদেষ্টা পদে ঠাঁই পাওয়ার মতো। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বস্ততাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
নতুন সরকার আমলে এলজিবিটি কমিউনিটি আরও বেশি সুবিধা পাবে। কেননা, উপদেষ্টাদের মধ্যে এনজিও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। সুশীল সমাজের একটি অংশ বিগত ওয়ান ইলেভেনের শুরুতে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভোল পাল্টে মিডিয়ার একটি অংশও বলেছিল এটি তাদের সরকার। এ সরকারেও তারা দেনদরবার করে নিজেদের সংহত করার, ক্ষমতার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছে।
প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা যারা হয়েছেন তারা নৈতিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকার কারণে সামনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বা কাউকে সমর্থন দেওয়ার পথে না হেঁটে দেশের জন্য কিছু ভালো কাজ করে যাবেন, এটাই মানুষের প্রত্যাশা। ছাত্র প্রতিনিধি দুজনকে এ কারণে অভিনন্দন। আমরা মুখে সবসময় বলি নতুন, তরুণ নেতৃত্ব চাই। অথচ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি শেষ করা এ দুই তরুণকে নেতৃত্বের কাতারে দেখতে সহ্য না হওয়া আমাদের ঈর্ষাগত জাতীয় সমস্যা। তরুণ দুজনের উচিত তাদের কাজ দিয়ে ছাত্রসমাজের সম্মান ধরে রাখা। ভোগে ব্যস্ত না হয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করা। অগ্রাধিকার তালিকায় কারামুক্তির জন্য বিএনপির অপু, মামুন, বাবরদের জন্য অনুরোধ নাকি গেছে খোদ তারেক রহমানের পক্ষ থেকে।
নতুন সরকার গঠনের আগে দেশে বহু খারাপ কাজ হয়েছে গত কয়েক দিনে। লুটপাট, ডাকাতি, চাঁদাবাজির পাশাপাশি দেশের শীর্ষ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া রাতারাতি ভোল পাল্টেছে। দ্রুতলয়ে খোলস পাল্টাচ্ছে আমাদের বর্ণচোরা সুবিধাকামী সমাজ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভালো কিছু করে দেখানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অবশ্যই আমাদের সময় দেওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টা ২৭টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখেছেন। দ্রুত নতুন কয়েকজনকে প্রয়োজনে যুক্ত করার সুযোগ রেখেছেন। কাজ করার সুযোগ নিজের হাতে রেখেছেন।
শেখ হাসিনা প্রশাসন পাঠ্যপুস্তক, ইতিহাসে সব কিছু গত ষোল বছরে ইচ্ছে খুশিমতো সাজিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাকেও চলে যেতে হয়েছে। উন্নয়নের গল্পের চেয়ে গুণগত রাজনীতি মানুষের প্রত্যাশা সেটি প্রমাণিত হয়েছে। রাজনীতি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই রাজনীতিতে যতক্ষণ সমাজের অপেক্ষাকৃত ভালো মানুষগুলো সামনে না আসতে পারবেন, ততক্ষণ ভালো কিছু সম্ভব নয়। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমার পেশা হলো জনমনে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তরের খোঁজ করা। বিভিন্ন সরকার আমলে জার্সি বদল করা সুবিধাবাজ, দালাল, ক্ষমতার পদলেহন করা কিছু ভৃত্য আছে। তারা ছাড়া পেশাদার সাংবাদিকের কোনো দল নেই। নৈতিক সাংবাদিকের কোনোকালে কোনও রাজনৈতিক ট্যাগ থাকে না, থাকতে নেই।
ক্ষমতার বদল হলেও নৈতিক, পেশাদার সাংবাদিকের জন্য পরিস্থিতি বদলে যাবে, সেই উচ্চ আশা কখনও করি না। চলতি বাস্তবতায় পাপ, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল,পাল্লার মতো মার্কা ও ছদ্মবেশী সুশীলের গন্তব্য কেবলই ক্ষমতা। ক্ষমতা কামড়ে থাকা অথবা ক্ষমতায় পৌঁছার লড়াই। এই আন্দোলন চলাকালেও সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, শিল্পীদের নির্লজ্জ দালালি সাধারণ মানুষদের হতবাক করেছে। বরং বহুবার ক্ষমতার মার্কা বা চেহারা বদল হলেও নৈতিক আদর্শ না বদলানো, পথ দেখানো মানুষের মুখগুলোর সারি যেন দীর্ঘ হয়, সেই দিন দেখার প্রত্যাশায় থাকি। আমরা শুধু ক্ষমতার মুখগুলোর পরিবর্তন চাই না। অর্থবহ ইতিবাচক পরিবর্তনের ভিত্তিপ্রস্তর হোক। দেশের শাসক, রাজনীতিবিদরা ভালো হলে, দুর্নীতি কমাতে পারলে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া হতে মাত্র ৫ বছর লাগবে।
লেখক: যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সাংবাদিক