লাইফস্টাইল ডেস্ক: ঈদে গ্রামে বেড়াতে যাওয়া অর্পিতা ফারজানা বলেন, সাত বছর পর ছোট ফুফির দেশে ফেরা উপলক্ষে পরিবারের সবাই মিলে এবার যাওয়া হয়েছিল গ্রামের বাড়ি। ছোটবেলায় মায়ের চাকরির সুবাদে শুধু আমরাই থাকতাম দূরে, গ্রামের বাড়িতে আর সবাই মিলে ছিল যৌথ পরিবার। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গেলেই শুরু হতো হুল্লোড়।
বরিশাল বিভাগের স্বরূপকাঠি থানায় আমার বাড়ি। আমার নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি—দুটোই একই এলাকায়। রান্নার ধারাটাও তাই একই রকম। আমাদের এলাকায় যেকোনো জমায়েতেই আঞ্চলিক রান্নার ধুম পড়ে যায়। যার মধ্যে আছে কলাপাতায় রান্না বিভিন্ন শাকসবজি, কলাপাতায় ভাজা বিভিন্ন ছোট মাছের চচ্চড়ি, বড় মাছভাজি, ভাপা চিংড়ি, ইলিশের নানা পদ, খেজুরের রসের পায়েসসহ বিভিন্ন পিঠাপুলি।
কিছু খাবার আছে, চাইলেও যা ঢাকায় রান্না করা যায় না বা বানালেও সেই স্বাদটা কেন যেন আসে না। কাজির জাউ তেমনই একটি খাবার। শহুরে ভাষায় একে ডাবের ডেজার্টও বলতে পারেন। এটি স্বরূপকাঠির ভীষণ উপাদেয় একটি খাবার। দাদার বাড়ির গাছের টাটকা ডাবের মিষ্টি পানি আর ডাবের শাঁস দিয়ে এবার তৈরি হলো এই খাবার।
সকাল থেকে বাড়িতে শুরু হয় তোড়জোড়। প্রথমে গাছ থেকে ডাব পাড়ার জন্য আসেন গাছি। গাছ থেকে ৫৫টির মতো ডাব পাড়া হলো। তারপর সেই টাটকা ডাবগুলো কেটে পানি আর শাঁস আলাদা করে নেওয়া হলো। শাঁসগুলো ছোট থেকে মাঝারি টুকরা করে কাটা হয়। চুলায় আরেকটি পাতিলে পানি ঢেলে চালের গুঁড়া, সামান্য লবণ আর কোরানো নারকেল সেদ্ধ করতে দেওয়া হলো। চাল-নারকেল সেদ্ধ হলে হালকা ঠান্ডা হওয়ার জন্য একদিকে নামিয়ে রাখা হলো। এরপর বাড়ির সবাই মিলে হাতে নিয়ে নিয়ে তৈরি করি চালের গুঁড়ার মুঠি। আরেকটি চুলায় বড় পাতিলে ৫৫টি ডাবের পানি জ্বাল দেওয়া হতে থাকল। বাড়ির ছেলেরা দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করছিল। পানি ফুটে উঠলে ডাবের শাঁস ও খানিকটা কোরানো নারকেল দিয়ে আরও খানিকক্ষণ জ্বাল দেওয়া হলো।
সবশেষে বানিয়ে রাখা চালের মুঠিগুলো দিয়ে দেওয়া হলো। মুঠিগুলো সেদ্ধ হয়ে ফুটে উঠলে সামান্য চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে ঘন করার জন্য পাতিলে ঢেলে দেওয়া হয়। কেউ বেশি মিষ্টি পছন্দ করলে স্বাদমতো চিনি ছড়িয়ে নিতে পারেন। পিঠাগুলো ফুটে উঠলেই তৈরি হয়ে যায় দারুণ উপাদেয় এক খাবার। নামিয়ে ঠান্ডা করে তবেই পরিবেশন করতে হয়। তবে এখানে নামাতে না নামাতে হাতে হাতেই শেষ হয়ে যায় কাজির জাউ।
আমাদের অঞ্চলে কাজির জাউকে পিঠাই বলে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়- এটা পিঠা কম, পায়েস বেশি। রেফ্রিজারেটরে রেখে খেলে স্বাদ যেন হয় দ্বিগুণ।
ফেরার সময় ঢাকায় থাকা আত্মীয়দের জন্যও নিয়ে এসেছিলাম এই পিঠা। আমার খালার বাসায়ও পাঠানো হলো। কিন্তু ভীষণ পছন্দের এই পিঠা তিনি মুখে তুলতে পারলেন না। কারণ তার মা, মানে আমার নানুর খুব প্রিয় খাবার ছিল এই কাজির জাউ। জীবনের শেষ সময়ে খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু গ্রাম থেকে বানিয়ে আনার আগেই উনি মারা যান। মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আঞ্চলিক এই খাবারগুলো শুধু যেন খাবার নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আমাদের প্রিয়জনদের আনন্দ আর কষ্টের কত–না গল্প। যে খাবার স্বরূপকাঠিতে আমাদের দিয়েছিল এক আনন্দের দিন, সেই খাবার যেন ঢাকায় এসে একরাশ মন খারাপের গল্প মনে করিয়ে দিল।
ছোটবেলায় নানি-দাদি যখন নিয়মিত এসব খাবার রান্না করতেন, সেগুলোর মূল্য তখন বুঝতাম না। আর এখন বড় হয়ে বুঝি, নিজের জীবনে যত ব্যস্ত হচ্ছি, ততই যেন হারিয়ে যাচ্ছে শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ। এই আঞ্চলিক খাবারগুলো স্বাদের থেকেও অনেক বেশি কিছু, অনেক আবেগের।