জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে থেকে বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ২০২৪ সালের ২২ মার্চ হাঁটা শুরু করেন সাইফুল ইসলাম। বাংলাদেশ, ভারত, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস হয়ে এখন তিনি আছেন মালয়েশিয়া। সেখানে কেটেছে তার ঈদুল ফিতরের দিন। অন্যদিকে ইকরামুল হাসান এভারেস্ট জয় করতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে হাঁটা শুরু করেন। বাংলাদেশ, ভারত হয়ে পৌঁছে গেছেন নেপাল। পথে ভারতের নকশালবাড়িতে কেটেছে তার ঈদ। ওইসব নিষ্ঠুরতা ও সারা জীবনের মায়া জন্মানো কথা সাইফুল আর ইকরামুল লিখেছেন পাঠকদের জন্য। এ বিষয় নিয়েই এবারের লাইফস্টাইল পাতার প্রধান ফিচার
সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মতো মালয়েশিয়াতেও সেদিন ঈদ। আমি আছি কুয়ালালামপুরের শ্রীরামপাই এলাকায়। পরিবার ছাড়া এবং দেশের বাইরে এটি আমার তৃতীয় ঈদ।
আমার হেঁটে বিশ্ব ভ্রমণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত ২২ মার্চ। এই সময়ে ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের বেশি পথ হেঁটেছি।
গত রমজানের ঈদে ছিলাম হুগলির কামারকুণ্ডু গ্রামে। ভারতের পশ্চিম বাংলায় হেঁটে ভ্রমণের সময় এই গ্রামের অনেকের সঙ্গে পরিচয়। সেই সূত্রে ঈদে কামারকুণ্ডু গ্রামের সবাই যেন আমাকে নিয়ে আনন্দে মেতে ছিল। ঈদ উপলক্ষে তাদের বাসায় দাওয়াত ছিল। পরিবারকে মিস করার সময়ই পাইনি। এরপর কোরবানির ঈদ করি তাজিকিস্তানে। খুজান্দ শহরে এক অপরিচিত বন্ধুর বাসায়। তাজিকিস্তানে আমার ট্রলি ঠিক করার সময় তার সঙ্গে পরিচয়। আগ্রহভরে বাসায় নিয়ে গেল। তাজিকিস্তানে ভেবেছিলাম খুব আনন্দ হবে ঈদে; কিন্তু হলো উল্টো। আগের রাতে ঈদের কোনো আমেজই পেলাম না। পথে কোনো পশুও দেখতে পাইনি। আসলে তাজিকিস্তানের ঈদের সংস্কৃতি একেবারেই আলাদা। ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে থেকেও সেদিন পরিবারের মতো ভালোবাসা অনুভব করেছিলাম। সেদিনও পরিবারকে খুব একটা মিস করা হয়নি।
ভ্রমণের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর প্রথমবারের মতো মালয়েশিয়ায় ঈদ করব। এবারের ঈদে আমার প্রধান আকর্ষণ মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পুরুষদের পোশাক বাজু মেলায়ু। এই পোশাকের মূল আকর্ষণ হচ্ছে কোমরের অংশের কাপড়, যোকে ওরা বলে সাম্পিং।
মালয়েশিয়াতে আমি বর্তমানে যে বন্ধুর বাসায় আছি, সেখানে ছয়জন থাকেন। তারা একটি সুপারশপে কাজ করেন।
ঈদের দিন ডিউটি থাকায় বন্ধু রহমতুল্লাহ রাতেই খাসির মাংস রান্না করে রেখেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সেমাই রান্না করে, সবাই খেয়ে বাজু মেলায়ু পরে ঈদের নামাজের জন্য মসজিদে যাই।
মালয়েশিয়ায় নারী-পুরুষ একই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। নারীদের জন্য আলাদা জায়গা আছে।
প্রচুর মানুষের উপস্থিতিতে ঈদের নামাজ আদায়ের পর আমরা একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। অনেকেরই বাসায় যাওয়ার তাড়া ছিল। কারণ ডিউটিতে যেতে হবে।
মালয়েশিয়ায় প্রচুর বাংলাদেশি আছেন। অনেকেই খুব ভালো অবস্থানে আছেন, আবার অনেকেরই খুব খারাপ অবস্থা। তবে পরিবার ছাড়া ঈদের একাকিত্ব সবার চেহারায় ফুটে উঠেছে।
স্থানীয় মালয়েশিয়ানরা তাদের পরিবার নিয়ে মসজিদে এসেছেন। মা, বাবা, বউ, ছেলে, মেয়ে—সবাই ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদ এসেছেন, এই দৃশ্য দেশে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে।
নামাজ শেষে বাংলাদেশিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে ও ছবি তুলে বিদায় নিই। বাসায় এসে খাবার খেয়ে আমার বন্ধুরা তাদের ডিউটিতে চলে যায়।
এখানে যারা পরিবার নিয়ে আছেন, তাদের কাছে ঈদ মানে আনন্দ। কিন্তু একশ্রেণির মানুষের জন্য ঈদের সময়টা বড় নিষ্ঠুর-বিষাদময়। কারণ তাদের কাছে ঈদ আসলে এক অদ্ভুত একাকিত্বের গল্প। পরিবারহীন, আত্মীয়-বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ এক উৎসব। এদিনটা অনেকের জন্য কষ্টের দিন হয়ে ওঠে।
বন্ধুরা বেরিয়ে গেলে আমিও খাবার খেয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্য, শহরের ঈদ উদ্যাপন দেখব।
হাঁটতে হাঁটতে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার্সের দিকে গেলাম। সেখানে স্থানীয় মালয়েশিয়ানদের উপস্থিতি বেশি না হলেও বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের উপস্থিতিতে প্রচুর ভিড়। প্রচুর বাংলাদেশির সঙ্গেও দেখা হলো, কথা হলো।
দেখলাম ঈদের দিনেও অনেক প্রবাসী ডিউটিতে ব্যস্ত। কেউ হয়তো পরিবারের সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলেননি। কারণ, ঈদের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারেননি। কেউ হয়তো তার পছন্দের খাবার রান্না করেননি।
অনেকে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছেন, শুধু নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। যেন একাকিত্বের কষ্ট হৃদয়ে না বাজে। অনেকেই পরিবারকে ভিডিও কল দিয়ে ঈদের আনন্দ দেখাচ্ছিলেন, যেন তারা কত আনন্দে আছেন। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে তাদের কষ্টটা বোঝা যায়।
প্রথমবারের মতো এবার আমি আমার দেশ, পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীদের সবাইকে মিস করেছি, ভীষণ মিস করেছি। সত্যিই, ঈদ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। প্রিয়জনদের ছাড়া ঈদ যেন শূন্যতায় ঢাকা এক অনুভূতি।
নকশালবাড়িতে ঈদ আজীবনের মায়া
ইকরামুল হাসান বলেন, অভিযানটার নাম দিয়েছি ‘সি টু সামিট’। এই অভিযান আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। দিয়েছে নির্ঘুম রাত, দুশ্চিন্তা, চোখের জল, ভয় আর অপ্রিয় সব অভিজ্ঞতা। কিন্তু সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা ভুলে যাই, যখন তার রঙিন আঁচলে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রকৃতি, যখন নিঃস্বার্থভাবে আমার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় অচেনা সব মানুষ। তারা আমাকে চেনে না, জানে না। তবু কোথাও যেন এক আত্মিক সংযোগ গড়ে ওঠে।
তেমনই এক মানুষ লিটন সরকার। শিলিগুড়ির পানিট্যাংকিতে আমাদের পরিচয়, যখন হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত আমি রাত্রিযাপনের জন্য একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম। লিটন পাশে দাঁড়াল, হোটেল খুঁজতে সাহায্য করল। কিন্তু সাশ্রয়ী কিছু পাওয়া গেল না। লিটনের বাবা, যিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান, খবর পেয়ে নকশালবাড়ি থেকে ছুটে এলেন। বললেন, ‘বিপদে পড়েছ, তোমাকে এটুকু সাহায্যও যদি না করি, তাহলে মানুষ হলাম কেন? এই গরিবের বাড়িতে থাকতে কি তোমার অসুবিধা হবে?’
তার কথায় থমকে গেলাম। ১৯৬৭ সালে এই নকশালবাড়িতেই হয়েছিল নকশাল আন্দোলন; যা ভারতের অন্যতম বড় কৃষক বিপ্লবের সূচনা করে। কৃষক বিদ্রোহের সেই পুণ্যভূমিতে থাকতে আমার অসুবিধা হবে! বহুদিনের স্বপ্ন ছিল, সেখানে একদিন যাব। যদিও এ যাত্রায় খুব বেশি ঘুরে দেখার সময় নেই, তবু কিছতা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ তো মিলবে! তাদের সঙ্গে চললাম নকশালবাড়ি। পথে এক মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়ে লিটনের বাবা বললেন, ‘এতা পথ হেঁটে এসেছ, আগে কিছু খাও।’ জোর করে পাঁচটি মিষ্টি পাতে তুলে দিলেন। মিষ্টি আমি বেশি খেতে পারি না, তবু দুটি খেলাম, এ যে ভালোবাসার দান।
বাড়িতে পৌঁছে অবাক হলাম। লিটনের মা আমাকে এমন মমতায় আপন করে নিলেন যে মনে হলো, জন্ম থেকেই আমি তাদের ঘরের সন্তান। আমাকে ঘিরে তাদের কত ব্যস্ততা! স্নানের জল গরম করে দেবেন কি না, গায়ে শর্ষের তেল মাখব কি না, আমি কী খেতে চাই- সবকিছু নিয়ে যেন মাতৃস্নেহের এক উৎসব লেগে গেল।
কুয়ার শীতল জলে গা ভিজতেই শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে গেল। নিঃসঙ্গ পথের ধুলো, সারা দিনের ক্লান্তি আর গরমের অবসাদ একনিমেষে মিলিয়ে গেল। এই জলে স্নান শুধু শরীরকে সতেজ করল না, মনকেও এক অদ্ভুত স্বস্তিতে ভরিয়ে দিল।
স্নান শেষে ফিরে দেখি চা, পিঠা, শিঙাড়া ও মিষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছেন মা। ‘আরেকটু দিই? আরেকটু দিই?’ কত যে আদর! রাতের খাবারেও একই দৃশ্য। এত আয়োজনের পরও তার দুঃখ, হঠাৎ করে চলে আসায় ভালো কিছু করে খাওয়াতে পারলেন না!
পরদিন ঈদ। সকালেই দেখি মা আমার জন্য সুজির হালুয়া রান্না করেছেন। ঈদের নামাজ পড়তে চাই শুনে নিজে আমাকে মাঠে নিয়ে গেলেন বাবা। নকশালবাড়িতে মুসলমানদের বসবাস আছে, এখানকার কেন্দ্রীয় ঈদগাহে ঈদের নামাজ শুরু সকাল সাড়ে নয়টায়। আমরা হাঁটতে হাঁটতে সময়মতোই সেখানে পৌঁছে গেলাম। মাঠের প্রবেশদ্বারটি সুন্দরভাবে সাজানো।
ভেতরে গিয়ে পেছনের একটি কাতারে দাঁড়ালাম। আশপাশের কয়েকজনের সঙ্গে ঈদের কুশলবিনিময় হলো। যখন শুনলেন বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং তাদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে এসেছি, তখন যেন এক অদৃশ্য বাঁধনে তারা আমাকে আপন করে নিলেন। নামাজ শেষ হলে অনেকেই এগিয়ে এলেন, কোলাকুলি করলেন। বের হয়ে দেখি, বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
বাড়িতে ফিরে দেখি, মা খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। একসঙ্গে খেলাম। আরও একটা দিন থেকে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করলেন মা। কিন্তু আমাকে তো পথ চলতেই হবে। বিদায়ের আগে মায়ের সঙ্গে আমার মায়ের ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিলাম। দুই মা কথা বলছেন, আর আমি চোখের জল আড়াল করছি।
বিদায়ের সময় মা মাথায়–গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বাবা, মাকে ভুলে যেয়ো না। তুমি অবশ্যই সফল হবে। তোমার কষ্টের ফল তুমি পাবে। ফিরে এসো, আমি অপেক্ষায় থাকব।’
আমি কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম। বারবার ফিরে তাকাচ্ছি, দেখছি, অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছেন মা।