ঢাকা ০৭:০৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ই-সিগারেট ডেকে আনছে তরুণ প্রজন্মের ধ্বংস

  • আপডেট সময় : ০২:২০:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৩
  • ২৬ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু প্রতিবেদন : দেশে ২০১৩ সালে তামাক আইন করা হলেও এখনও বন্ধ হয়নি তামাকের ব্যবহার। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো নানা ধরনের প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শিশু-কিশোররা। দেশে আইন থাকার পরও কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না তামাকের ব্যবহার? আইনের সমস্যা ও জটিলতাগুলো কোথায় না কি সংশোধন প্রয়োজন? এমন একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তামাক আইনের জটিলতা, সমস্যা ও সমাধানের কথা।
৫ বছর ধরে সিগারেটে আসক্ত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক জাহিদ হাসান। পরিবার প্রকাশ্যে ধূমপান করতে না দেওয়ায় সম্প্রতি ভিন্নপথ অবলম্বন করেছেন তিনি। এখন তিনি ই-সিগারেট খান। কারণ হিসেবে জাহিদ জানালেন, এটি সহজে বহনযোগ্য এবং সিগারেটের তুলনায় প্রচুর ধোঁয়া পাওয়া যায়। জাহিদ হাসানের মতো বাংলাদেশে প্রতিদিন অনেক যুবক সিগারেট ছেড়ে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছেন। সহজে বহনযোগ্য ভেবে এটিকে বেছে নিচ্ছেন অধিকাংশ যুবক। ই-সিগারেটে নিকোটিন তরল আকারে থাকে, যা তাপে ধোঁয়া তৈরি হয়। এছাড়া সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেটে নিকোটিন বেশি থাকে যা ব্যবহারকারীর মধ্যে আসক্তি বাড়ায়। কিন্তু অনেকে জানেনই না ই-সিগারেট কতটা ভয়াবহ। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে তামাক বিরোধী আইন সংশোধিত করা হলেও সেখানে ই-সিগারেট নিয়ে কোনো কিছুই বলা হয়নি। ফলে ভয়ঙ্কর এই সিগারেট বিক্রি ও সেবনকারীর সংখ্যা বেড়ে চলছে আশঙ্কাজনকহারে। এই ধরনের সিগারেটের ব্যাপারে আইন করা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগারেটের মতোই কাজ করে ই-সিগারেট। কিন্তু ই-সিগারেটে নিকোটিনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। এতে নিকোটিনের পাশাপাশি আরও কিছু উপাদান যুক্ত করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়। বিশ্বের অনেক দেশে এমন ঘটনা আছে। বাংলাদেশে দিনদিন ই-সিগারেট ব্যবহার বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই ধরনের সিগারেট বন্ধ করা হলেও বাংলাদেশে এখনো এমন সিগারেট বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে এমন সিগারেটে আসক্ত মানুষের সংখ্যা। গত কয়েক বছর থেকে ই-সিগারেট বাংলাদেশের বাজারে প্রচার পেয়েছে। বিশেষ করে উঠতি যুবক ও যুবতিরা এটাতে আসক্ত। নানা আকারের নানা ফ্লেভারের সিগারেট সহজেই কিশোর তরুণদের আকৃষ্ট করছে। বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এই সিগারেটের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শ্রীলঙ্কা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৫০টি দেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশের তরুণ কিশোরদের নিরাপদ রাখতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধের কোনো বিকল্প নেই।
ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬-এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সকল পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (এঅঞঝ) ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠির মধ্যে পরিচালিত হয় বলে এই গবেষণার মাধ্যমে ইমার্জিং টোবাকো প্রোডাক্ট ব্যবহারে প্রকৃত চিত্র পাওয়া কঠিন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে পরিচালিত গেটস অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার শূন্য দুই শতাংশ। ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিংয়ের ধোঁয়ায় নিকোটিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত কেমিক্যাল থাকে যা ব্যবহারকারী এবং এর পরোক্ষ ধূমপানের শিকার উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো ব্যবহারকারীর ফুসফুসের সংক্রমণ ও অসুস্থতা বাড়ায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট) স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ সহায়ক। বিশ্বের অনেক দেশ এসব পণ্য নিয়ন্ত্রণে/বন্ধে ইতোমধ্যে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ব্যবহার ক্রমবর্ধমানহারে বাড়লেও এগুলো নিয়ন্ত্রণে/বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের পদ্ধতি ও ব্যবহার, বিপণন কৌশল, তামাকাসক্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কৌশলি প্রচার-প্রচারণার কারণে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার বর্তমানে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ এবং কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে। পাশাপাশি আগামী প্রজন্মকে করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা যাবে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের চেয়ে ধূমপানকারীদের ফুসফুসের ক্যানসারের হার অনেক বেশি। ধূমপানের কারণে স্ত্রী, সন্তানসহ তাঁর সংস্পর্শে থাকা অন্যদেরও বিভিন্ন প্রকার ক্ষতি হয়। একজন ধূমপানকারীর অনাগত সন্তান বিকলাঙ্গসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ধূমপানের ফলে শ্বাসযন্ত্র ক্ষতি হয়। ধূমপানে কিশোর-কিশোরীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ে। যেমন তাদের শরীরের চামড়া এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে নিজেদের বয়সের তুলনায় বেশি বয়সী মনে হয়। অধিকাংশ মুখের ক্যানসারই ধূমপানের জন্য হয়। ধূমপানের ফলে মানুষের পাকস্থলীর ক্ষতি হয়। ধূমপান থেকে ধূমপায়ীরা অন্যান্য মাদকের দিকে যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধূমপান করেন, তারা সাধারণত প্রথম দিকে গাঁজা ও অ্যালকোহলে আক্রান্ত হন। পরে অন্যান্য মাদক গ্রহণ করেন। এটি ধূমপানের একটি ভয়ঙ্কর দিক। তামাক এমন একটি উপকরণ, যাতে মানুষের ন্যূনতম উপকার নেই। ধূমপানের ভয়াবহতা থেকে তাই মানুষকে বাঁচাতেই হবে। ই-সিগারেট নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, তামাক পাতার নির্যাস ই-সিগারেটের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিগারেট যেমন আসক্তি তৈরি করে তেমনি ই-সিগারেটও একই কাজ করে। নিকোটিন আমাদের ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রে দেখানো হয়েছে, ই-সিগারেট তৈরিতে যদি আরও কিছু কেমিক্যাল মেশানো হয় তবে তা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। অনেকে ফুসফুসে আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন এমন ঘটনাও আছে।
সোহেল রেজা আরও বলেন, ই-সিগারেট মানুষের নেশা তৈরি করে। প্রথম দিকে অনেকে ভেবেছিল ই-সিগারেট এলে মানুষ সিগারেট ছাড়বে, কম ক্ষতি করবে। কিন্তু এখন তো তার পুরোটাই উল্টো হচ্ছে। আসলে নেশার জন্য মানুষ এই ই-সিগারেট তৈরি করছে এটা প্রমাণিত হচ্ছে। এটা সহজে বহন ও লুকিয়ে রাখা যায়, তাই এমন সিগারেটের প্রতি তরুণরা বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। অনেকে এটা প্রকাশ্যে ব্যবহার করছে। তাদের দেখে শিশুরাও এটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ই-সিগারেট যে ফুসফুসের ক্ষতি করে ও আসক্তি তৈরি করে এটা প্রমাণিত হয়েছে। তামাক ও ধূমপান বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। ধূমপানকারী ব্যক্তি বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। চিকিৎসকদের এক হিসাবে দেখা গেছে, কেউ প্রতিদিন ধূমপান করলে তার ১৪ মিনিট করে আয়ু কমতে থাকে। তামাকের ভয়াবহতা হ্রাসে বাংলাদেশ সরকার ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসিতে (ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল) স্বাক্ষর করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৫৭ হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ববরণ করে প্রায় চার লাখ মানুষ। ধূমপানের ক্ষতি ছাড়া কোনো ধরনের উপকার নেই।
শিশু-কিশোর এবং তরুণরাই মূল টার্গেট: মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডব্লিউএইচও এর ২০২১ সালের তথ্য মতে, বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত (ফ্লেভার) ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭ শতাংশ বেড়েছে। স্বাদ বা গন্ধ পছন্দ হওয়ায় হাইস্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে।
বাংলাদেশেও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক। রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকহারে চোখে পড়ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয় কেন্দ্র। অনলাইন এবং ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা, বিক্রয় ও হাতবদল হচ্ছে। তবে এসব পণ্য ব্যবহারের মাত্রা কতটা বিস্তার লাভ করেছে সে বিষয়ে সবশেষ কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নেই বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
ই-সিগারেট নিয়ে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘ই-সিগারেট ভয়ঙ্কর জিনিস। এটার আলোচনা ৫ থেকে ৬ বছরও ছিল না। তামাক কোম্পানিগুলো কৌশলে তামাক জাতীয় পণ্যের বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেট তারা তৈরি করেছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে টার্গেট করে এসব ই-সিগারেট তৈরি করে তারা। তাতে নানা সুগন্ধি ও ফ্লেবার ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করা হয়। এটা খুবই ভয়াবহ। আমেরিকা ও ইউরোপে এটা ব্যাপকহারে বেড়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা ব্যাপকহারে শুরু হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের দেশের স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এসবে আসক্ত হয়ে পড়বে। আমরা চাচ্ছি এটা যেনো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের প্রতিবেশি দেশ এটা বাতিল করেছে। শুধু ভারতই নয়, তাদের মতো আরও ৩৫টি দেশ ই-সিগারেট বন্ধ করেছে। আমরা এ কারণে চাচ্ছি কারণ হচ্ছে, আমাদের উঠতি তরুণ ও কিশোর সমাজকে সুরক্ষিত করা প্রয়োজন। এটা তামাক পণ্যের মতোই সমান ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ফুসফুসজনিত রোগে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৮০৭ জন। এর মধ্যে ৬৮ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেট/ভ্যাপিংয়ের যোগসূত্র ছিল। অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, হু রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোবাক্যো ইপিডেমিক ২০২১ -এ ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ইএনডিএস) অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো আসক্তিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য ক্ষতি তৈরি করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা এসব পণ্যে আসক্ত তাদের মধ্যে সিগারেট শুরু করার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্ট তামাকপণ্য ব্যবহারের প্রধান মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠির ৪৯ শতাংশই তরুণ। যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। তামাক কোম্পানিগুলোও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠিকে যেকোনো উপায়ে তামাকপণ্য ও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টে আসক্ত করে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং মুনাফা বৃদ্ধি করতে চায়। এজন্য তারা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদিকে সিগারেটের ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে ভোক্তা এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে। ই-সিগারেটের বিষয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খন্দকার বলেন, ‘এটি অবশ্যই ভয়ঙ্কর। আমরা ই-সিগারেট বন্ধের জন্য আইন করব। বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সামনের সংশোধিত আইনে বিষয়টি যুক্ত করা হবে।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ই-সিগারেট ডেকে আনছে তরুণ প্রজন্মের ধ্বংস

আপডেট সময় : ০২:২০:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৩

নারী ও শিশু প্রতিবেদন : দেশে ২০১৩ সালে তামাক আইন করা হলেও এখনও বন্ধ হয়নি তামাকের ব্যবহার। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো নানা ধরনের প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শিশু-কিশোররা। দেশে আইন থাকার পরও কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না তামাকের ব্যবহার? আইনের সমস্যা ও জটিলতাগুলো কোথায় না কি সংশোধন প্রয়োজন? এমন একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তামাক আইনের জটিলতা, সমস্যা ও সমাধানের কথা।
৫ বছর ধরে সিগারেটে আসক্ত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক জাহিদ হাসান। পরিবার প্রকাশ্যে ধূমপান করতে না দেওয়ায় সম্প্রতি ভিন্নপথ অবলম্বন করেছেন তিনি। এখন তিনি ই-সিগারেট খান। কারণ হিসেবে জাহিদ জানালেন, এটি সহজে বহনযোগ্য এবং সিগারেটের তুলনায় প্রচুর ধোঁয়া পাওয়া যায়। জাহিদ হাসানের মতো বাংলাদেশে প্রতিদিন অনেক যুবক সিগারেট ছেড়ে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছেন। সহজে বহনযোগ্য ভেবে এটিকে বেছে নিচ্ছেন অধিকাংশ যুবক। ই-সিগারেটে নিকোটিন তরল আকারে থাকে, যা তাপে ধোঁয়া তৈরি হয়। এছাড়া সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেটে নিকোটিন বেশি থাকে যা ব্যবহারকারীর মধ্যে আসক্তি বাড়ায়। কিন্তু অনেকে জানেনই না ই-সিগারেট কতটা ভয়াবহ। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে তামাক বিরোধী আইন সংশোধিত করা হলেও সেখানে ই-সিগারেট নিয়ে কোনো কিছুই বলা হয়নি। ফলে ভয়ঙ্কর এই সিগারেট বিক্রি ও সেবনকারীর সংখ্যা বেড়ে চলছে আশঙ্কাজনকহারে। এই ধরনের সিগারেটের ব্যাপারে আইন করা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগারেটের মতোই কাজ করে ই-সিগারেট। কিন্তু ই-সিগারেটে নিকোটিনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। এতে নিকোটিনের পাশাপাশি আরও কিছু উপাদান যুক্ত করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়। বিশ্বের অনেক দেশে এমন ঘটনা আছে। বাংলাদেশে দিনদিন ই-সিগারেট ব্যবহার বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই ধরনের সিগারেট বন্ধ করা হলেও বাংলাদেশে এখনো এমন সিগারেট বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে এমন সিগারেটে আসক্ত মানুষের সংখ্যা। গত কয়েক বছর থেকে ই-সিগারেট বাংলাদেশের বাজারে প্রচার পেয়েছে। বিশেষ করে উঠতি যুবক ও যুবতিরা এটাতে আসক্ত। নানা আকারের নানা ফ্লেভারের সিগারেট সহজেই কিশোর তরুণদের আকৃষ্ট করছে। বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এই সিগারেটের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শ্রীলঙ্কা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৫০টি দেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশের তরুণ কিশোরদের নিরাপদ রাখতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধের কোনো বিকল্প নেই।
ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬-এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সকল পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (এঅঞঝ) ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠির মধ্যে পরিচালিত হয় বলে এই গবেষণার মাধ্যমে ইমার্জিং টোবাকো প্রোডাক্ট ব্যবহারে প্রকৃত চিত্র পাওয়া কঠিন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে পরিচালিত গেটস অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার শূন্য দুই শতাংশ। ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিংয়ের ধোঁয়ায় নিকোটিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত কেমিক্যাল থাকে যা ব্যবহারকারী এবং এর পরোক্ষ ধূমপানের শিকার উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো ব্যবহারকারীর ফুসফুসের সংক্রমণ ও অসুস্থতা বাড়ায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট) স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ সহায়ক। বিশ্বের অনেক দেশ এসব পণ্য নিয়ন্ত্রণে/বন্ধে ইতোমধ্যে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ব্যবহার ক্রমবর্ধমানহারে বাড়লেও এগুলো নিয়ন্ত্রণে/বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের পদ্ধতি ও ব্যবহার, বিপণন কৌশল, তামাকাসক্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কৌশলি প্রচার-প্রচারণার কারণে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার বর্তমানে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ এবং কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে। পাশাপাশি আগামী প্রজন্মকে করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা যাবে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের চেয়ে ধূমপানকারীদের ফুসফুসের ক্যানসারের হার অনেক বেশি। ধূমপানের কারণে স্ত্রী, সন্তানসহ তাঁর সংস্পর্শে থাকা অন্যদেরও বিভিন্ন প্রকার ক্ষতি হয়। একজন ধূমপানকারীর অনাগত সন্তান বিকলাঙ্গসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ধূমপানের ফলে শ্বাসযন্ত্র ক্ষতি হয়। ধূমপানে কিশোর-কিশোরীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ে। যেমন তাদের শরীরের চামড়া এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে নিজেদের বয়সের তুলনায় বেশি বয়সী মনে হয়। অধিকাংশ মুখের ক্যানসারই ধূমপানের জন্য হয়। ধূমপানের ফলে মানুষের পাকস্থলীর ক্ষতি হয়। ধূমপান থেকে ধূমপায়ীরা অন্যান্য মাদকের দিকে যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধূমপান করেন, তারা সাধারণত প্রথম দিকে গাঁজা ও অ্যালকোহলে আক্রান্ত হন। পরে অন্যান্য মাদক গ্রহণ করেন। এটি ধূমপানের একটি ভয়ঙ্কর দিক। তামাক এমন একটি উপকরণ, যাতে মানুষের ন্যূনতম উপকার নেই। ধূমপানের ভয়াবহতা থেকে তাই মানুষকে বাঁচাতেই হবে। ই-সিগারেট নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, তামাক পাতার নির্যাস ই-সিগারেটের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিগারেট যেমন আসক্তি তৈরি করে তেমনি ই-সিগারেটও একই কাজ করে। নিকোটিন আমাদের ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রে দেখানো হয়েছে, ই-সিগারেট তৈরিতে যদি আরও কিছু কেমিক্যাল মেশানো হয় তবে তা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। অনেকে ফুসফুসে আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন এমন ঘটনাও আছে।
সোহেল রেজা আরও বলেন, ই-সিগারেট মানুষের নেশা তৈরি করে। প্রথম দিকে অনেকে ভেবেছিল ই-সিগারেট এলে মানুষ সিগারেট ছাড়বে, কম ক্ষতি করবে। কিন্তু এখন তো তার পুরোটাই উল্টো হচ্ছে। আসলে নেশার জন্য মানুষ এই ই-সিগারেট তৈরি করছে এটা প্রমাণিত হচ্ছে। এটা সহজে বহন ও লুকিয়ে রাখা যায়, তাই এমন সিগারেটের প্রতি তরুণরা বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। অনেকে এটা প্রকাশ্যে ব্যবহার করছে। তাদের দেখে শিশুরাও এটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ই-সিগারেট যে ফুসফুসের ক্ষতি করে ও আসক্তি তৈরি করে এটা প্রমাণিত হয়েছে। তামাক ও ধূমপান বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। ধূমপানকারী ব্যক্তি বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। চিকিৎসকদের এক হিসাবে দেখা গেছে, কেউ প্রতিদিন ধূমপান করলে তার ১৪ মিনিট করে আয়ু কমতে থাকে। তামাকের ভয়াবহতা হ্রাসে বাংলাদেশ সরকার ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসিতে (ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল) স্বাক্ষর করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৫৭ হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ববরণ করে প্রায় চার লাখ মানুষ। ধূমপানের ক্ষতি ছাড়া কোনো ধরনের উপকার নেই।
শিশু-কিশোর এবং তরুণরাই মূল টার্গেট: মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডব্লিউএইচও এর ২০২১ সালের তথ্য মতে, বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত (ফ্লেভার) ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭ শতাংশ বেড়েছে। স্বাদ বা গন্ধ পছন্দ হওয়ায় হাইস্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে।
বাংলাদেশেও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক। রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকহারে চোখে পড়ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয় কেন্দ্র। অনলাইন এবং ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা, বিক্রয় ও হাতবদল হচ্ছে। তবে এসব পণ্য ব্যবহারের মাত্রা কতটা বিস্তার লাভ করেছে সে বিষয়ে সবশেষ কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নেই বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
ই-সিগারেট নিয়ে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘ই-সিগারেট ভয়ঙ্কর জিনিস। এটার আলোচনা ৫ থেকে ৬ বছরও ছিল না। তামাক কোম্পানিগুলো কৌশলে তামাক জাতীয় পণ্যের বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেট তারা তৈরি করেছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে টার্গেট করে এসব ই-সিগারেট তৈরি করে তারা। তাতে নানা সুগন্ধি ও ফ্লেবার ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করা হয়। এটা খুবই ভয়াবহ। আমেরিকা ও ইউরোপে এটা ব্যাপকহারে বেড়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা ব্যাপকহারে শুরু হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের দেশের স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এসবে আসক্ত হয়ে পড়বে। আমরা চাচ্ছি এটা যেনো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের প্রতিবেশি দেশ এটা বাতিল করেছে। শুধু ভারতই নয়, তাদের মতো আরও ৩৫টি দেশ ই-সিগারেট বন্ধ করেছে। আমরা এ কারণে চাচ্ছি কারণ হচ্ছে, আমাদের উঠতি তরুণ ও কিশোর সমাজকে সুরক্ষিত করা প্রয়োজন। এটা তামাক পণ্যের মতোই সমান ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ফুসফুসজনিত রোগে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৮০৭ জন। এর মধ্যে ৬৮ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেট/ভ্যাপিংয়ের যোগসূত্র ছিল। অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, হু রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোবাক্যো ইপিডেমিক ২০২১ -এ ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ইএনডিএস) অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো আসক্তিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য ক্ষতি তৈরি করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা এসব পণ্যে আসক্ত তাদের মধ্যে সিগারেট শুরু করার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ, ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্ট তামাকপণ্য ব্যবহারের প্রধান মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠির ৪৯ শতাংশই তরুণ। যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। তামাক কোম্পানিগুলোও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠিকে যেকোনো উপায়ে তামাকপণ্য ও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টে আসক্ত করে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং মুনাফা বৃদ্ধি করতে চায়। এজন্য তারা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদিকে সিগারেটের ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে ভোক্তা এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে। ই-সিগারেটের বিষয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খন্দকার বলেন, ‘এটি অবশ্যই ভয়ঙ্কর। আমরা ই-সিগারেট বন্ধের জন্য আইন করব। বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সামনের সংশোধিত আইনে বিষয়টি যুক্ত করা হবে।’