ঢাকা ১০:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

আমলারা সহযোগী না হলে অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষে দেশ চালানো কঠিন

  • আপডেট সময় : ১১:৫০:১০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ অগাস্ট ২০২৪
  • ৩৯ বার পড়া হয়েছে

আমীন আল রশীদ : একটি অভুতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৭ সদস্যের যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে, তাদের দপ্তর বণ্টন করা হয়েছে।
এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, সড়ক ও সেতু, কৃষি, জনপ্রশাসন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, তথ্য ও সম্প্রচারসহ ২৭টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টা নিজের হাতে রেখেছেন। বাকি ১৩ জনের মধ্যে অন্যান্য মন্ত্রাণালয় বণ্টন করা হয়েছে। যেমন, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, স্থানীয় সরকারে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প মন্ত্রণালয়ে সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান ইত্যাদি। এই আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের প্রতিনিধি মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যথাক্রমে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
এখানে মূল চ্যালেঞ্জ স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার কাঁধে। একজন মানুষের পক্ষে ২৭টি মন্ত্রণালয় চালানো শুধু কঠিন নয়, রীতিমতো অসম্ভব। যে তিনজন শপথ নেননি, শপথ নেওয়ার পরে তাদের মধ্যেও দপ্তর বণ্টন করা হবে। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার ওপর থেকে হয়তো তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেমে যাবে। কিন্তু তারপরও থাকবে ২৪টি। এটিও অংকের হিসাবে অনেক।
ধারণা করা হচ্ছে, অন্তর্র্বতী সরকারে উপদেষ্টার সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। উপদেষ্টাদের সংখ্যা যদি শেষমেষ ২৫ হয়, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কিছুটা সহজ হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা দায়িত্ব পেলেন, তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে কতটা অভিজ্ঞ। কেননা একটি প্রতিষ্ঠান চালানো আর রাষ্ট্র চালানোর মধ্যে তফাৎ অনেক। সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা করে অনেকে এই সরকারকে ‘এনজিও সরকার’ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা ১৭ জনের মধ্যে পাঁচজনই এনজিও ব্যক্তিত্ব, যা শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ। মনে রাখতে হবে, প্রশাসন খুব জটিল জায়গা এবং মন্ত্রণালয়ের মূল কাজগুলো করেন আমলারা। তারা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সঠিকভাবে গাইড না করেন বা সহযোগিতা না দেন, তাহলে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন এর আগে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। ফলে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়গুলো বোঝেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ফলে আশা করা যায় তিনি অতীতের অন্য অনেকের চেয়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো ভালোমতো সামাল দিতে পারবেন। সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তিনিও দক্ষ ও অভিজ্ঞ। কিন্তু তারপরও এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি সরকারের পতন ঘটানো যত কঠিন, তারপরে নানাবিধ সংকটে থাকা সেই দেশটিকে এগিয়ে নেওয়া আরও কঠিন। সেই কঠিন কাজের দায়িত্ব যাদের ওপর, তাদের শারীরিক ও মানসিক ফিটনেসের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজে দক্ষতা খুব প্রয়োজন। বিশেষ করে আমলাদের সঙ্গে তাদের যদি কোনও ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়, সেটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি কঠিন করে তুলবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘একজন অসৎ আমলা এক হাজার শয়তানের চেয়েও ভয়ংকর।’ সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আমলাতন্ত্র ঠিক করা প্রথম কাজ। সেই কাজটি কে করবেন?
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টা নিজের হাতে রেখেছেন। এটা তার জন্য কঠিন। তার উচিত হবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদিউর রহমান বা তার মতো কোনও সাবেক ঝানু আমলা, যিনি ব্যক্তিজীবনে সৎ, চাকরি জীবনে যার বিরুদ্ধে কোনও দুনীতির অভিযোগ ছিল না, যিনি সাহসী এবং দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যিনি যেকোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবেন না, এমন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া।
মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে সরকারের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ খাদ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠবে যদি সে বাজার করতে গিয়ে অস্বস্তিতে ভোগে। যদি নিত্যপণ্যের বাজারে আগের মতোই অস্থিরতা বিরাজ করে, সেটি জনমনে অসন্তোষ তৈরি করবে। অতএব বাজার ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়গুলো বোঝেন এমন কোনও ব্যক্তিকে উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত করা উচিত। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকেও কাউকে নেওয়া যায়। দিন শেষে রাষ্ট্র পরিচালনা রাজনীতিরই বিষয়। ছাত্র আন্দোলনের যে দুজন এই সরকারে আছেন, তারা এখনও ওই অর্থে রাজনীতিবিদ নন। সম্ভবত তারা নিজেরাও নিজেদেরকে ‘রাজনীতিবিদ’ মনে করেন না। আবার এও ঠিক যে, বছরের পর বছর ধরে দেশের মানুষ রাজনীতির নামে যা দেখেছে; রাজনৈতিক নেতাদের যে চরিত্র দেখেছে— তাতে তাদের ওপর আস্থাও কম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশের সব রাজনীতিবিদই অসৎ বা দুর্নীতিবাজ নন। নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রধান প্রধান দলগুলোতে অনেক ক্লিন ইমেজের নেতা আছেন। সেখান থেকে দুয়েকজনকে যুক্ত করা গেলে ভালো। তাতে করে অন্তর্র্বতী সরকার একটি জাতীয় সরকারে রূপ পাবে।
ধারণা করা হচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এই অন্তর্র্বতী সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকবে বা থাকতে চাইবে। সেক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার কঠিন হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্র্বতী সরকারের বদলে আসলে প্রয়োজন জাতীয় সরকার।
পরিশেষে, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা যতই ভালো মানুষ হোন না কেন, তাদের অফিসিয়াল কাজকর্মগুলো করতে হবে আসলে আমলাদের দিয়েই। বছরের পর বছর ধরে যে অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এসেছে, তার অন্যতম প্রধান কারিগর এই আমলারা— সেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অতএব এই সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করছে তাদের ওপর। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার উচিত হবে আমলাতন্ত্রে হাত দেওয়া এবং এই কাজে অবশ্যই দুয়েকজন সাবেক ঝানু আমলাকে সঙ্গে নিতে হবে— যারা ফাঁকফোকরগুলো জানেন। আমলারা কোথায় কীভাবে দুর্নীতি করেন এবং কোন কোন প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহযোগিতা এমনকি অসহযোগিতা করতে পারেন, সেগুলো জানাবোঝা লোক ছাড়া আমলাতন্ত্র ঠিক করা যাবে না। আর আমলাতন্ত্র ঠিক করতে না পারলে রাষ্ট্র সংস্কারের কাঙ্ক্ষিত কাজটি ব্যর্থ হয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

গুমের তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি কমিশনের

আমলারা সহযোগী না হলে অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষে দেশ চালানো কঠিন

আপডেট সময় : ১১:৫০:১০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ অগাস্ট ২০২৪

আমীন আল রশীদ : একটি অভুতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৭ সদস্যের যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে, তাদের দপ্তর বণ্টন করা হয়েছে।
এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, সড়ক ও সেতু, কৃষি, জনপ্রশাসন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, তথ্য ও সম্প্রচারসহ ২৭টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টা নিজের হাতে রেখেছেন। বাকি ১৩ জনের মধ্যে অন্যান্য মন্ত্রাণালয় বণ্টন করা হয়েছে। যেমন, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, স্থানীয় সরকারে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প মন্ত্রণালয়ে সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান ইত্যাদি। এই আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রদের প্রতিনিধি মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যথাক্রমে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
এখানে মূল চ্যালেঞ্জ স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার কাঁধে। একজন মানুষের পক্ষে ২৭টি মন্ত্রণালয় চালানো শুধু কঠিন নয়, রীতিমতো অসম্ভব। যে তিনজন শপথ নেননি, শপথ নেওয়ার পরে তাদের মধ্যেও দপ্তর বণ্টন করা হবে। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার ওপর থেকে হয়তো তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেমে যাবে। কিন্তু তারপরও থাকবে ২৪টি। এটিও অংকের হিসাবে অনেক।
ধারণা করা হচ্ছে, অন্তর্র্বতী সরকারে উপদেষ্টার সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। উপদেষ্টাদের সংখ্যা যদি শেষমেষ ২৫ হয়, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কিছুটা সহজ হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা দায়িত্ব পেলেন, তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে কতটা অভিজ্ঞ। কেননা একটি প্রতিষ্ঠান চালানো আর রাষ্ট্র চালানোর মধ্যে তফাৎ অনেক। সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা করে অনেকে এই সরকারকে ‘এনজিও সরকার’ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা ১৭ জনের মধ্যে পাঁচজনই এনজিও ব্যক্তিত্ব, যা শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ। মনে রাখতে হবে, প্রশাসন খুব জটিল জায়গা এবং মন্ত্রণালয়ের মূল কাজগুলো করেন আমলারা। তারা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সঠিকভাবে গাইড না করেন বা সহযোগিতা না দেন, তাহলে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন এর আগে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। ফলে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়গুলো বোঝেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ফলে আশা করা যায় তিনি অতীতের অন্য অনেকের চেয়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো ভালোমতো সামাল দিতে পারবেন। সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তিনিও দক্ষ ও অভিজ্ঞ। কিন্তু তারপরও এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি সরকারের পতন ঘটানো যত কঠিন, তারপরে নানাবিধ সংকটে থাকা সেই দেশটিকে এগিয়ে নেওয়া আরও কঠিন। সেই কঠিন কাজের দায়িত্ব যাদের ওপর, তাদের শারীরিক ও মানসিক ফিটনেসের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজে দক্ষতা খুব প্রয়োজন। বিশেষ করে আমলাদের সঙ্গে তাদের যদি কোনও ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়, সেটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি কঠিন করে তুলবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘একজন অসৎ আমলা এক হাজার শয়তানের চেয়েও ভয়ংকর।’ সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আমলাতন্ত্র ঠিক করা প্রথম কাজ। সেই কাজটি কে করবেন?
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টা নিজের হাতে রেখেছেন। এটা তার জন্য কঠিন। তার উচিত হবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদিউর রহমান বা তার মতো কোনও সাবেক ঝানু আমলা, যিনি ব্যক্তিজীবনে সৎ, চাকরি জীবনে যার বিরুদ্ধে কোনও দুনীতির অভিযোগ ছিল না, যিনি সাহসী এবং দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যিনি যেকোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবেন না, এমন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া।
মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে সরকারের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ খাদ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠবে যদি সে বাজার করতে গিয়ে অস্বস্তিতে ভোগে। যদি নিত্যপণ্যের বাজারে আগের মতোই অস্থিরতা বিরাজ করে, সেটি জনমনে অসন্তোষ তৈরি করবে। অতএব বাজার ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়গুলো বোঝেন এমন কোনও ব্যক্তিকে উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত করা উচিত। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকেও কাউকে নেওয়া যায়। দিন শেষে রাষ্ট্র পরিচালনা রাজনীতিরই বিষয়। ছাত্র আন্দোলনের যে দুজন এই সরকারে আছেন, তারা এখনও ওই অর্থে রাজনীতিবিদ নন। সম্ভবত তারা নিজেরাও নিজেদেরকে ‘রাজনীতিবিদ’ মনে করেন না। আবার এও ঠিক যে, বছরের পর বছর ধরে দেশের মানুষ রাজনীতির নামে যা দেখেছে; রাজনৈতিক নেতাদের যে চরিত্র দেখেছে— তাতে তাদের ওপর আস্থাও কম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশের সব রাজনীতিবিদই অসৎ বা দুর্নীতিবাজ নন। নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রধান প্রধান দলগুলোতে অনেক ক্লিন ইমেজের নেতা আছেন। সেখান থেকে দুয়েকজনকে যুক্ত করা গেলে ভালো। তাতে করে অন্তর্র্বতী সরকার একটি জাতীয় সরকারে রূপ পাবে।
ধারণা করা হচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এই অন্তর্র্বতী সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকবে বা থাকতে চাইবে। সেক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার কঠিন হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্র্বতী সরকারের বদলে আসলে প্রয়োজন জাতীয় সরকার।
পরিশেষে, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা যতই ভালো মানুষ হোন না কেন, তাদের অফিসিয়াল কাজকর্মগুলো করতে হবে আসলে আমলাদের দিয়েই। বছরের পর বছর ধরে যে অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এসেছে, তার অন্যতম প্রধান কারিগর এই আমলারা— সেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অতএব এই সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করছে তাদের ওপর। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার উচিত হবে আমলাতন্ত্রে হাত দেওয়া এবং এই কাজে অবশ্যই দুয়েকজন সাবেক ঝানু আমলাকে সঙ্গে নিতে হবে— যারা ফাঁকফোকরগুলো জানেন। আমলারা কোথায় কীভাবে দুর্নীতি করেন এবং কোন কোন প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহযোগিতা এমনকি অসহযোগিতা করতে পারেন, সেগুলো জানাবোঝা লোক ছাড়া আমলাতন্ত্র ঠিক করা যাবে না। আর আমলাতন্ত্র ঠিক করতে না পারলে রাষ্ট্র সংস্কারের কাঙ্ক্ষিত কাজটি ব্যর্থ হয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক