জন্মের সাথে সাথেই শিশু একটা পরিচয় পেয়ে যায়। কিছু সুবিধা নিয়ে শিশুর জন্ম হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নতুন নতুন পরিচয়, নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত হতে থাকে। পরিচয়ে পরিচয়ে, সুবিধায় সুবিধায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ফারাক থাকে। কেউ বাঙালি, কেউ চাকমা; কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু; কেউ শহরের, কেউ গ্রামের; কেউ সচিব, কেউ কেরানি ইত্যাদি। ধনীর সন্তান গরীবের সন্তানের চেয়ে বেশি সুবিধা পায়, মুসলিম হিন্দুর চেয়ে বেশি সুবিধা পায়, বাঙালি চাকমার চেয়ে বেশি সুবিধা পায়, সুদর্শন যুবক অসুন্দর যুবকের চেয়ে বেশি সুবিধা পায়, ফর্সা মেয়ে কালো মেয়ের চেয়ে বেশি সুবিধা পায়, ইত্যাদি। পরিচয়ের সমরূপতা থেকে, সুবিধার সমরূপতা থেকে, নানারূপ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ও তৈরি হয়। মানুষ বিচিত্র সব দলে বিভক্ত হয়। পরিচয় ও সুবিধা ভিত্তিক রাজনীতির উদ্ভব হয়। লক্ষ্য থাকে বৈষম্যের বিলোপ বা সুবিধার বৃদ্ধি।
রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিচয়ের প্রধান ভিত্তি ভাবাদর্শ, বিশ্ববীক্ষা, ধর্ম। দল যদি একটা আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হয় তাহলে আদর্শজাত পরিচয়কে প্রধান করে তুলতে চাইতে পারে সেই দল। এই পরিচয়ের সাথে মিশ্রিত করা হয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা, আবেগ। তৈরি হয় ‘আমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি’, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ ধরনের উত্তেজনা। জন্ম নেয় হিংসা ও সৃষ্টি হয় অত্যাচারের উৎস। প্রতিটি দল তখন অন্য দলগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
পরিচয় প্রয়োজন হয় প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে। এ প্রয়োজন একটি আবশ্যিকতা। পরিচয় যদি আবশ্যক হয় তাহলে পরিচয় রাজনীতির কুফল থেকে মুক্ত থাকবো কিভাবে? একই সাথে পরিচয় ও পরিচয়হীনতা কীভাবে সম্ভব? এর একটি উপায় হচ্ছে পরিচয়ের প্রাসঙ্গিকতার প্রতি নজর রাখা। যে পরিচয় যেখানে অপ্রাসঙ্গিক, সেখানে সে পরিচয় বিবেচনায় না আনা। সবক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিকভাবে পরিচয় টেনে আনা, পরিচয়কে উপস্থাপন করা, পরিচয়কে প্রয়োগ করা হলেই পরিচয় বিপদজনক হয়ে ওঠে। যেমনÑ আপনি বিচারক, ন্যায়বিচার করা আপনার কাজ। কিন্তু আপনি যদি বলতেই থাকেন, ‘আমি মুসলিম, ইসলাম ন্যায়বিচারের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেয়; তাই ন্যায়ই আমার ধর্ম, আমার পক্ষেই ন্যায় নিশ্চিত করা সম্ভব’ তাহলে আপনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে আপনার ‘এই ক্ষেত্রটিতে অবান্তর’ পরিচয়কে বড় করে তুললেন। বিচারকের আসনে ন্যায় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার দক্ষতাই আসল কথা, আপনার অন্য সব পরিচয় অবান্তর। আপনি অক্সফোর্ডের ছাত্র, আপনার এ ক্লাস রেজাল্ট, আপনি হিন্দু না মুসলিম, বাঙালি না চাকমাÑ এসবই অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক।
তেমনভাবেই রাজনীতিতে লক্ষ্য হচ্ছে জনগণকে স্বাধীন পরিবেশ দেয়া, তাদের নিরাপত্তা দেয়া, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, জীবনমানে উন্নয়ন আনা; ইনক্লুসিভভাবে রাষ্ট্রের সবার জন্য, সাম্যের সাথে। একটি দল নিজেদের গড়ে তোলার জন্য ইসলামকে গ্রহণ করতে পারে; কিন্তু উক্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের ধর্ম, ধর্মাদর্শের তথাকথিত ‘শ্রেষ্ঠত্ব’, ধর্মের অরাজনৈতিক লক্ষ্য ইত্যাদি রাজনীতির অঙ্গনে অবান্তর। জনতার সামনে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে ধর্ম ও ধর্মীয় পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর বিধায় এ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেই পরিচয় থেকে উৎপন্ন সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
এখানে পরিচয়জাত সংকট নিয়ে আলোচনা। ইসলাম হোক বা সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ হোক বা বাংলাদেশি, নিবারেল হোক বা কনসারভেটিভÑ সব আদর্শের বেলায়ই অন্য আরও সমস্যা আছে।
লেখক: লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া
আইডেন্টিটি পলিটিক্স
ট্যাগস :
শিশুর জন্ম
জনপ্রিয় সংবাদ