বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে আমার জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি হলো এর রাজনৈতিক দর্শন। একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। আগস্টের ৫ তারিখ শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পরপর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলো ভাঙা হলো। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর অর্থাৎ ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবের বাসভবন লুটপাট করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। খুব সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নেতার ভাস্কর্য অসম্মানের এমন নজির আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
কেন, শেখ মুজিব কেন? শেখ মুজিব তো এই পৃথিবীতে নেই গত প্রায় পঞ্চাশ বছর। মৃত মুজিব এই গোষ্ঠীর কাছে জীবিত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালী বেশি তাহলে। শুধু শেখ মুজিব তো নন, দেখা গেলো আমাদের স্বাধীনতার ভাস্কর্যগুলোও ভাঙ্গা হলো বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি মুজিবনগরে। কিন্তু এসব কাজের সরাসরি সমালোচনা না করে বরং নীরব থাকা হলো। অনেকে বললেন, এর জন্য তার কন্যাই দায়ী। এটিকে যেন বৈধতা দেওয়া হলো।
উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্যও এর বিরুদ্ধে কথা বললেন না। একটি পুলিশি মামলা বা লোক দেখানো তদন্ত করারও প্রয়োজন মনে করলেন না। বলা হলো, কন্যা শেখ হাসিনার কাজের ফলাফল বঙ্গবন্ধুকে বহন করতে হচ্ছে। তাহলে স্বাধীনতার ভাস্কর্যগুলো কী দোষ করলো? এই জাতীয় মনোভাব বঙ্গবন্ধুর অসম্মান এবং স্বাধীনতার ভাস্কর্য ভাঙ্গাকে কি বরং উৎসাহিত করল না? এরপরই এ সরকারের জন্য এসিড টেস্টের দিন ১৫ আগস্ট এলো। সরকার অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে শোক দিবসের ছুটি বাতিল করলো। এরপর যারা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শোক প্রকাশ করতে গেলেন তাদের ওপর হলো নিপীড়ন। এছাড়া ১৫ আগস্ট রাতে এই ভয়াবহ দিনটিকে উদযাপন করা হলো লুঙ্গি ডান্স দিয়ে। একজন সমন্বয়ক বললেন, এই কাজটি “বিপ্লবের” স্পিরিটের সাথে যায় না। এ পর্যন্তই।
প্রধান উপদেষ্টা কিছুই বললেন না; এই ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশা অনেক ছিল। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেওয়া স্বাধীনতার ফসল এই বাংলাদেশের একজন নোবেল লরিয়েট; আমার প্রত্যাশা পূর্ণ হলো না।
সম্প্রতি ড. ইউনূস ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতার ভাস্কর্যগুলোর অবমাননা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এর সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আপনি পুরনো দিনের কথাবার্তা বলছেন। এর মধ্যে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেছে আপনার মনে হয় স্মরণে নেই। আপনি এমনভাবে কথা বলছেন, যেন এসব ঘটনা ঘটেই নাই। কাজেই নতুন ভঙ্গিতে যা হচ্ছে, এটা দেখতে হবে তো। কত ছেলে প্রাণ দিল সেটি নিয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন নেই। কেন প্রাণ দিল। কাজেই ওগুলো আসুক। তারপরে… প্রথম স্বীকার করতে হবে যে, তারা বলেছেÑ ছাত্ররা বলেছে যে, আমরা রিসেট বাটন পুশ করেছি। এভরিথিং ইজ গন।’
যাই হোক, আমি অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এমন আক্রমণগুলোর কী কারণ। প্রধান উপদেষ্টা বা অন্য উপদেষ্টারা বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ভাস্কর্য ধ্বংসকারীদের একটি ন্যূনতম আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের প্রয়োজন মনে করলেন না। আমার কাছে এই সরকারের রাজনৈতিক দর্শনটি অনেকটাই অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। তাদের নির্লিপ্ততা এই অস্পষ্টতা তৈরি করেছে।
মনে রাখা দরকার, শেখ মুজিব এখনো সাংবিধানিকভাবে এ দেশের জাতির পিতা এবং দেশটির স্বাধীনতার ঘোষণা এই সংবিধানের অংশ। এই সরকার শপথ নিয়েছে সংবিধান রক্ষার। কাজেই যখনই বঙ্গবন্ধু ও আমাদের স্বাধীনতাকে অপমান করা হয় সেটি এক ধরনের অপরাধ অবশ্যই। এটির ব্যাপারে চুপ থাকাটা অনেকটাই এসব কাজে শাসকদের সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান এখনো সাংবিধানিকভাবে আমাদের জাতির পিতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধানতম নেতা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সবার জন্য অবশ্যই আমরাও শোকাহত, এর বিচারও অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু সেটার জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক করা কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তা আমরা সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারছি না। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও সেদিন শিশু, নারী, ও গর্ভবতী খুন হয়েছিলেন কোনো রকম রাজনীতির সাথে জড়িত না থেকেই। এমন ঘটনা কেন ঘটেছিল আমরা জানি।
প্রয়াত শ্রদ্ধেয় মইন উদ্দীন খান বাদল একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেনÑ কেন স্বাধীনতাবিরোধীরা শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তার পুরো পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্মকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক (চযুংরপধষ ঊসনড়ফরসবহঃ)। কাজেই তাকে শেষ করার সাথে সাথে তার বংশধরদেরও শেষ করা দরকার ছিল; যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে পরবর্তীকালে কেউ আবির্ভূত হতে না পারে। তাদের এই নৃশংস পরিকল্পনার বাস্তবায়ন থেকে শিশু রাসেল ও মাতৃগর্ভের ভ্রƒণও বাদ যায়নি। কাজেই তাদের জন্য শোক প্রকাশ করা তাদের খুনি বা স্বাধীনতাবিরোধী বা বেনিফিসিয়ারিদের কাছ থেকে আমরা আশা করি না কোনো সময়েই। জাতি হিসেবে আমাদের এক ধরনের বোঝাপড়া যে, এই প্রজাতির মানুষরাই কেবল বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করতে দ্বিধা করে বা তাকে অবজ্ঞা করে। তো এই প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের অবস্থান কোনটি?
মনে রাখা দরকার, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটাই বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ভুলে যাচ্ছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা কাদের পক্ষ নিচ্ছেন? ১৯৭৫-এর পরও বঙ্গবন্ধু লম্বা সময়ের জন্য আড়াল হয়েছিলেন; আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য আমরা দেখেছি। স্বাধীনতাবিরোধীরা ’৭১-এ তাদের ভূমিকা নিয়ে জাতির সামনে এখনো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি।
বাংলাদেশের ইতিহাসের পরতে পরতে স্বাধীনতার ন্যারেটিভ পরিবর্তন করার চেষ্টা হয়েছে। ফলে বঙ্গবন্ধুকে একটি দল নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে। যা তাকে আবারও অপমানের জায়গায় নিয়ে গেছে। ইতিহাসে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থানটিও লেখা থাকবে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের জাতির জনকের নাম ধরে বলেন, তাকে ‘ভুলের’ প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে, মানে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়াটাই তার ভুল ছিল অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ভুল ছিল; তখন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ জানানোর সাহস পায় না! ভুল বলেছি? হ্যাঁ, সাহসই পায় না।
যদি এমন হতো যে, আমাদের সরকার থেকে বলা হতো, পাকিস্তান তৈরি করার ধারণাটিই ভুল। এবং এর জন্য দায়ী ছিলেন জিন্নাহ, তবে পাকিস্তান কি চুপ করে থাকতো? দেখা যেত তারা এর প্রতিবাদে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে তাদের পররাষ্ট্র দফতরে অবশ্যই ডেকে নিতেন।
একজন লোক আমাদের জাতীয় সংগীত পাল্টানোর কথা বলতে পারেন, এমনকি পাকিস্তানের হাইকমিশনার আমাদের তরুণ উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে রাজনৈতিক মন্তব্য করতে পারেন। এ আমলের প্রধানতম বুদ্ধিজীবীদের এসব বিষয়ে জোরে কথা বলতে দ্বিধা করেন। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ডিসকোর্সটি কোন দার্শনিক ভিত্তিতে অবস্থান করছে সেটিই বোঝা মুশকিল হয়ে গেছে।
আরেকটি বিষয়, আমাকে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক বা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের অবস্থান সম্পর্কে শঙ্কিত করে তুলেছে। অন্যদের কথা বাদ দিলাম। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে তার কোনো ভাষণে বা বিবৃতি কিংবা প্রেস কনফারেন্সে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে জেনোসাইডের শিকার হওয়া সব মানুষ অথবা ধর্ষণের শিকার হওয়া মা-বোনদের কথা স্মরণ করেননি।
শেখ হাসিনার বিষয়ে অবশ্যই সরকার কঠিন অবস্থানে থাকবে। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের জীবন দান, সম্ভ্রমহানি এগুলোর কোনো স্বীকৃতি এই প্রথমবারের মতো কোনো সরকারপ্রধানের কাছ থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। তিনি ‘সদ্য প্রাপ্ত স্বাধীনতার’ কথা প্রায়ই বলেন; ‘বিপ্লবের’ কথা বলেন; এই আন্দোলনে নিহত আমাদের সন্তানদের কথা বলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষের নিহত হওয়ার কথা তিনি বলেন না, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির কথাও আমরা শুনি না। এটি কেন?
গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি সংস্থা বেশ জানান দিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মদিন পালন করেছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এ আয়োজনটি দেখা গেল। ব্যক্তিগতভাবে আমি এতে কিছু মনে করি না। কারণ রাজনীতিক হিসেবে জিন্নাহর অনেক সমর্থক ও অনুসারী থাকতেই পারে। আমার সমস্যাটি অন্য জায়গায়। সেটি হলো এই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য। এ অনুষ্ঠানে দুটো বক্তব্য সত্যিই আপত্তিকরÑ এক. জিন্নাহ বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ করেছিলেন বলেই এ অঞ্চলটি বেঁচে গিয়েছিল এবং স্বাধীনতা অর্জন করেছিল এবং দুই. নজরুল ইসলাম নামে এক বক্তা বলেন, ‘পাকিস্তান না থাকলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের জাতির পিতা।’ ভেবে দেখুন একবার, এটিও সম্ভব?
আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের সংবিধান এখনো কার্যকর, যেহেতু এখনো বাতিল হয়নি। তাহলে এই বক্তব্যগুলো কীভাবে প্রকাশ্যে আসে? দুঃখটা এই যে, সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত জাতির পিতার মৃত্যুদিনে আমরা লুঙ্গি ডান্স করি; তার ভাস্কর্য, স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন ও মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরকে অবমাননা করি; আর আমাদের সাংস্কৃতির যে প্রাণ সেই ভাষাকে যিনি অবজ্ঞা করেছিলেন, যার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি আমাদের ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলÑ তার মৃত্যুদিনে আমরা তাকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করি।
এটি প্রকাশ্যে এসেছে প্রায় বেশ ক’দিন হয়ে গেল। তাদের বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। এর আগে গোলাম আজমের পুত্র হঠাৎ করে আমাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ বনাম তিনের বিতর্ক নিয়ে হাজির। মানুষ দেখছে। কিন্তু আমাদের সরকার যেন দেখছেও না, জানছেও না, শুনছেও না।
আমার মনে হচ্ছে একটি গোষ্ঠী স্বাধীনতা যুদ্ধের ন্যারেটিভ পরিবর্তন করতে চাইছে। এরা এই কাজটি করে যাচ্ছে খুব সন্তর্পনে, অনেকটা মরুভূমির উটের মতো, যেন কেউ কিছু বুঝছে না, দেখছে না; দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে- রাষ্ট্রযন্ত্র কি এ কাজটিকে নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে?
একটি ধর্মীয় রাজনীতির ধারকের দাবির কারণে সরকারের সরাসরি অ্যাকশানে চলে যাওয়া। দাবি ছিল, পাঠ্য বই সংস্কারের যে কমিটি করা হয়েছে সেখান থেকে দু’জন সদস্যকে বাদ দিতে হবে। কারণ তারা নাকি ‘ধর্মবিরোধী’। অথচ এ দু’জন সদস্য প্রাণপাত করে বিগত আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছিলেন এবং নিজেরাও অংশ নিয়েছিলেন। তখন তাদের এই অংশগ্রহণ নিয়ে এই গোষ্ঠীটি কোনো আপত্তি তোলেননি।
যাই হোক, এ দাবি উত্থাপিত হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পুরো কমিটিই বাতিল করে দিলেন। তো সরাসরি ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া, সাহসের সঙ্গে ছাত্রদের পাশে থাকা বুদ্ধিজীবীরাই যদি কাজ করতে বাধাগ্রস্ত হন তবে ‘সংস্কার’ কাদের দিয়ে করা হবে? সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশটির পরিচয় কি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে?
ড. শ্যামল দাস: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, এলিজাবেথ সিটি স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থ ক্যারোলিনা, আমেরিকা