করোনাকালের অ্যান্টিবায়োটিকে-রেজিস্ট্যান্স মহামারি!
করোনাকালের অ্যান্টিবায়োটিকে-রেজিস্ট্যান্স মহামারি!


প্রত্যাশা ডেস্ক : অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু করোনাকালে সেটি এমন বেড়েছে যে আগামী কয়েক বছরেই আমাদের চেনা অনেক রোগ হয়ে উঠতে পারে দুরারোগ্য। দেখা দিতে পারে নতুন নতুন মহামারি! অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোর যে সময় লাগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তার সময়কাল এগিয়ে এসেছে!
কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের বহির্বিভাগে জ্বর এবং কাশি নিয়ে যান মা-মেয়ে। চিকিৎসক তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিয়ে তাদের করোনা পরীক্ষার পরামর্শ দেন। অর্থাৎ করোনা হতে পারে ধরে নিয়েই অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিয়েছেন ওই চিকিৎসক।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর আশিক চৌধুরীকে করোনা পরীক্ষা দেন চিকিৎসক। হাসপাতালে ভর্তি হতেও বলে দেওয়া হয়। সঙ্গে একটি প্রেসক্রিপশন। আশিক চৌধুরী যখন ওষুধের দোকানে যান, তখন বিক্রেতা তাকে জিজ্ঞেস করেন, রোগী তার কী হয়? রোগী কি আইসিইউতে নাকি? আশিক চৌধুরী ঘাবড়ে যান। এমন ওষুধ তাকে দেওয়া হয়েছে যেগুলো সচরাচর আইসিইউতে ব্যবহার হয়। অ্যাজিথ্রোমাইসিন, রেমডিসিভিরসহ চারটি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেওয়া হয়েছিল তাকে!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হতে দেড় থেকে দুই যুগ সময় লাগে। অথচ মানুষের খামখেয়ালির কারণে সেটা তারচেয়ে দ্রুত অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে রোগের বিরুদ্ধে।
চিকিৎসকরা বলছেন, কোভিড ১৯-এর কোনও স্বীকৃত চিকিৎসা নেই। করোনা মহামারির প্রথম থেকেই তাই সাধারণ মানুষ নিজেরা নিজেদের প্রেসক্রিপশন দিতে শুরু করে। স্বজনের কাছ থেকে শুনে হোক কিংবা ফেসবুকে দেখে, অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছেন অনেকে। চিকিৎসকরাও অ্যান্টিবায়োটিকের নাম বলে চলেছেন সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে।
ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা ও বংশবৃদ্ধি রোধে ব্যবহৃত হয় অ্যান্টিবায়োটিক। এর যথেচ্ছ ব্যবহার হলে ব্যাকটেরিয়াগুলো তখন এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখে যায়। কমে যায় অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা। তখনই বলা হয় ব্যাকটেরিয়াটি ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ হয়ে গেছে। তখন যতই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা হোক না কেন, সেটা আর কাজ করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম থেকেই বারবার তাদের ওয়েবসাইটে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে সতর্ক করে আসছে। তারা বলেছে, কোভিড-১৯ একটি ভাইরাল অসুখ। এটিতে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক বা অ্যান্টি প্রটোজল ড্রাগের কোনও ভূমিকা নেই। গত ৮ মাস তাদের মিথ ব্লাস্টার সাইটে কাভার হিসেবে রাখার পরও কেউ এ কথাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের রক্তপরিসঞ্চালন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, ‘বেশিরভাগ প্রেসক্রিপশনে এখন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে ম্যারোপেনাম এবং মক্সিফ্লোক্সাসিন ইনজেকশন। সাধারণত আইসিইউতে যে রোগীদের শরীরে অন্য সব অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না, তাদের ম্যারোপেনাম দিতে হয়। ঢাকার বাইরে থেকে এরকম অনেক প্রেসক্রিপশনের কথা আমরা জানতে পারছি। যারা এ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক নিচ্ছে, তাদের শরীরে পরে আর কোনও অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না।’
ডা. আশরাফুল হক বলেন, ‘মনিটরিং না থাকায় অ্যান্টিবায়োটিকের বেশি অপব্যবহার হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে।’
তিনি বলেন, ‘এ কারণে কয়েক মাস পরই যদি একজন রোগীকে পুনরায় ভর্তি হতে হয়, তবে তাকে দেওয়ার মতো আর অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে না।’
জীবাণু যেভাবে ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে উঠছে তাতে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের ঘাটতি এক সময় আরও বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। গত ২০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বলে বিশ্ব নেতাদের সতর্ক করেছেন। সেদিন ‘ওয়ান হেলথ গ্লোবাল লিডার্স গ্রুপ অন অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স’-এর যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে কো-চেয়ারের বক্তব্যে একথা বলেন তিনি। অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্সের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত বৈশ্বিক উদ্যোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিম্যাল হেলথ-ওআইইয়ের উদ্যোগে এই গ্রুপ গড়ে তোলা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা কমে আসছে এবং এর ফলে বিশ্ব নতুন সঙ্কটে পড়তে পারে। যা কোভিড ১৯-এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে।”
এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর মহাপরিচালক টেড্রোস আধানোম গেব্রিয়াসিস ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারির সময় অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার মৃত্যু আরও বাড়াবে। খুব কম কোভিড-১৯ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয়। যাদের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রয়েছে কেবল তাদেরই এটি দরকার।’
একই কথা জানিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। অনেক হাসপাতালেই সরকার প্রণীত জাতীয় গাইডলাইন যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না বলে ২২ নভেম্বর এক সভায় মতামত দিয়েছে কমিটি।
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, গাইডলাইন না মানার কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।
‘পুরো বিশ্বই এ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন’ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিন্তু সেদিন এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ’সবাই জানে কোভিড ভাইরাসবাহিত। অথচ মানুষ খেয়েছে ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধী ওষুধ। অনেক চিকিৎসক সেটার পক্ষে আবার সাফাইও গাইছে।’
এ সংক্রান্ত গবেষণার কিছু ফল প্রকাশিত হচ্ছে জানিয়ে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বের শতকরা ৮ থেকে ১৫ ভাগ কোভিড আক্রান্ত রোগীর ব্যাকটেরিয়াল অথবা অন্য কোনও ইনফেকশন ছিল, যাদের এ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার হতো। রেসপিরেটরি ইনফেকশন হলে সঙ্গে আরও অন্য ইনফেকশন হয়। তার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হতে পারে। কিন্তু কোভিডের জন্য নয়।’
আরেক আশঙ্কা জানিয়ে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে এখন যাবতীয় গবেষণা অ্যান্টিবায়োটিক থেকে সরে ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিভাইরালে চলে গেছে। ফলে সহসা নতুন অ্যান্টিবায়োটিকও আসবে না। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের যে বিপর্যয়ের কথা বলা হচ্ছে তা আরও কয়েক বছর পর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড চলাকালীন মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে বলা চলে সময়টা দুই-তিন বছর এগিয়ে এলো। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এমন একটা অবস্থা আসবে যে আমাদের হাতে সাধারণ রোগ সারানোর মতো আর অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে না।’